বাংলাদেশের প্রাচীনতম বন্দর-নগরী উয়ারী-বটেশ্বর
৭দিনেরকাগজ
এতদিন আমাদের ধারণা ছিল প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন বা বর্তমান মহাস্থানগড়ই বাংলাদেশের আদি ঐতিহাসিক কালপর্বের একমাত্র প্রত্নক্ষেত্র৷ কিন্তু সমপ্রতি সে ধারণা পাল্টে গেছে৷ পুণ্ড্রবর্ধনের সমকালীন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার অন্তর্গত উয়ারী-বটেশ্বর নামক পাশাপাশি দুটি গ্রামে৷ যাঁর দূরদর্শিতা ও ঐতিহ্যপ্রীতির সম্মিলনে উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নক্ষেত্রটির বহুমাত্রিক গুরুত্ব বিদ্বত্সমাজে প্রতিভাসিত হয়েছে তিনি এ প্রবন্ধকারের পিতা মোহাম্মদ হানীফ পাঠান (১৯০১-১৯৮৯)৷ তিনিই প্রথম ১৯৩৩ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীতে 'প্রাচীন মুদ্রা প্রাপ্তি' শীর্ষক সংবাদ ছাপেন৷ তারপর ১৯৫৫ সালে 'পূর্ব পাকিস্তানে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা' শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে জনসমক্ষে স্থানটির প্রত্নতাত্তি্বক গুরুত্ব তুলে ধরেন৷ রাজধানী ঢাকা থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খাঁ নদীর মিলনস্থলের তিন কিলোমিটার পশ্চিমে কয়রা নামক (বর্তমান কয়রা খাল) নদীখাতের দক্ষিণ তীরে উয়ারী ও বটেশ্বর-এর অবস্থান৷ স্থানটির মাটির রং গৈরিক যা প্রাচীনতম পলি নামে অভিহিত৷ প্লাইস্টোসিন যুগে গঠিত মধুপুর গড়ের পূর্ব সীমান্তে গ্রাম দুটির অবস্থান৷ কয়রা নদীখাত উয়ারী গ্রামের উত্তর দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে এখনো দৃশ্যমান৷ এই অঞ্চলের ভূমিরূপ দেখে অনুমান করা যায় যে, প্রাচীন যুগে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটি প্রত্নস্থলের নিকট দিয়ে প্রবাহিত হতো৷ আড়িয়াল খাঁ নদীটি যেখানে কয়রার সঙ্গে মিলেছে সে স্থান থেকে প্রত্নস্থানটির দূরত্ব খুবই কম৷ প্রত্নস্থানটি অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমিতে অবস্থিত হওয়ায় বন্যার কবল থেকে মুক্ত৷ উল্লেখ্য যে মহাস্থানগড় (প্রাচীন পুণ্ড্রনগর) অঞ্চলেও প্রত্নস্থানগুলো অপেক্ষাকৃত উঁচুভূমিতে অবস্থিত বলে বন্যার কবল থেকে মুক্ত৷ ব্রহ্মপুত্র নদীর নৈকট্য এবং সহজে মেঘনার মত বিশাল নদীতে প্রবেশের সুযোগ উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নস্থানটিকে বহুমাত্রিকতা দান করে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে১৷ উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নক্ষেত্রটির পাশর্্ববর্তী রাইঙ্গার টেক, আলগারটেক, কান্দুয়া, হানিয়াবাইদ ও শিবপুর উপজেলার সোনারুতলা ও নওগাঁ (উয়ারী-বটেশ্বর গ্রামের পশ্চিম প্রান্ত সংলগ্ন) প্রভৃতি গ্রাম থেকে বহু মূল্যবান প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে৷ এগুলোর মধ্যে প্রত্নপ্রস্তর যুগের হাত-কুড়াল, অশ্মীভূত কাঠের বাটালি ((Chisel), পাথরের বাটালি (ডোলারাইট ও শ্লেটপাথরে তৈরী), স্কন্ধযুক্ত বাটালি, পাথরের ছুরি, বাট লাগানোর ছিদ্রহীন ত্রিকোণাকার লৌহ কুঠার, লোহার ফলক, বর্শা, পেরেক, ছুরি, দা, বাটালি, ক্ষুদ্রাকৃতি খেলনা হাত কুড়াল, লোহার ভারী হাতুড়ি বা পাটাতন, ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা, স্বল্পমূল্য পাথরের গুটিকা (Beads of Semi-precious Stone), কাচের গুটিকা ও পুঁতি (Glass Beads), পোড়া মাটির ক্ষেপণীয় গোলক (Terracotta Sling Ball), মৃত্ গুটিকা (Terracotta Beads), উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃত্পাত্র (Northern Black Porcelin Ware), কালো মসৃণ মৃত্পাত্র, নবড্ মৃত্পাত্র, রোলেটেড মৃত্পাত্র, উচ্চ মাত্রায় টিন মিশ্রিত নবড্ বাটি (High-tin Bronze Knobbed Bowl), পাথরের নব-যুক্ত বাটি ((Stone Knobbed Casket), ব্রোঞ্জনির্মিত নব-যুক্ত শিবকোষ (An offering Bronze Knobbed Plate of Shiva, Ganesh and Bull Marked), ব্রোঞ্জ বলয় (Bronze Bangle), মত্স্য জালে ব্যবহৃত মৃত্গোলক (Terracotta Net Sinker), রিংস্টোন (Ringstone), নক্শাঙ্কিত রক্ষাকবচ (Decorated Stone Locket), কৌশিক মৃত্পাত্র, টালি আকৃতির ইট, বহুছিদ্রযুক্ত ক্ষুদ্রকায় মৃত্পাত্র (ঝঃত্ধরহবত্), ক্ষয়িত হস্তীদন্ত, পাথরের তৈরী খুরাযুক্ত শিলনোড়া, পাথরের আয়তাকার বেদী, জন্তুর মুখের আদলে তৈরী মৃত্পাত্র প্রভৃতি নানা নিদর্শন৷ উয়ারী বটেশ্বর অঞ্চলে সম্ভবত প্রত্নপ্রস্তর যুগেই মানব বসতি শুরু হয়েছিল ৷ ১৯৮৩ সালে উয়ারী গ্রামের উত্তর প্রান্তে কয়রা নামক শুষ্ক নদীখাতের তীরবতর্ী উঁচুভূমি সমতল করার সময় শ্রমিকেরা একটি হাতকুঠার খুঁজে পায়৷ লাল মৃত্পাত্রের নীচের স্তর থেকে প্রাপ্ত বেলে পাথরে তৈরি কুঠারটি ছাগলনাইয়ায় প্রাপ্ত কুঠার থেকে ভিন্ন ধরনের৷ অনুমান করা যায় যে, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে প্রত্নপ্রস্তর যুগে মানব বসতির সূত্রপাত হয়েছিল৷ এছাড়া উয়ারীতে পঞ্চভুজাকৃতি একটি প্রস্তর খণ্ড, যেটির প্রান্ত ভাগ আনাড়িভাবে হাতিয়ারের আকৃতি দেওয়া হয়েছিল, সেটিকেও প্রত্নপ্রস্তর যুগের নিদর্শন হিসাবেই চিহ্নিত করা যায়৷ নব্যপ্রস্তর যুগের নয়টি বাটালি উয়ারী বটেশ্বর ও সনি্নহিত অঞ্চল থেকে সংগৃহীত হয়েছে৷ এরমধ্যে উয়ারী থেকে ৬টি, বটেশ্বর, বেলাব, বাইলারটেক, কামরাব, রাজাবাড়ী প্রভৃতি গ্রামের প্রতিটি থেকে একটি করে হাতিয়ার পাওয়া গেছে৷ দুটি হাতিয়ার বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে রক্ষিত আছে ৷ ছয় ই্িঞ্চ লম্বা, চৌফলা, অগ্রভাগ চোখা, মধ্যভাগ ঈষত্ বাঁকানো একটি পাথরের ছুরিও নব্যপ্রস্তর যুগের নিদর্শন৷ হাতিয়ারগুলো শ্লেট, ডোলেরাইট, বেলেপাথর ও অশ্মীভূত কাঠের তৈরি৷ বাংলাদেশের সীতাকুণ্ড, কুমিল্লার লালমাই, আনন্দবিহার, শালবন বিহার ও সিলেটের চুনারুঘাট থেকে নব্যপ্রস্তর যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্যযুক্ত বাটালি সংগৃহীত হয়েছে৷ উত্তরপূর্ব ভারতের নব্যপ্রস্তর যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল গোলাকার হাতল প্রান্তযুক্ত বাটালির সঙ্গে স্কন্ধযুক্ত বাটালি প্রাপ্তি, যেখানে ভারতবর্ষর্ের বিভিন্ন অঞ্চলে নব্যপ্রস্তর সংস্কৃতিতে এই দুই ধরনের বাটালি একত্র প্রাপ্তি আসাম তথা উত্তরপূর্ব ভারতের সাথে এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক যোগাযোগকেও ইঙ্গিত দেয়৷ এই সাংস্কৃতিক যোগাযোগের সূত্র ধরে উত্তরপূর্ব ভারতে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত শ্লেট, ডোলোরাইট ও বেলেপাথর হাতিয়ার নিমর্াণের কাঁচামাল হিসাবে উয়ারি বটেশ্বর অঞ্চলে সমপ্রসারিত হতে পারে৷২ উয়ারী ও কামরাব গ্রামে প্রাপ্ত দুটি অশ্মীভূত কাঠের বাটালি (Celt) প্রাপ্তিতে মনে হয় এগুলো স্থানীয়ভাবে নির্মিত নয়_স্থানান্তর থেকে আমদানিকৃত৷ কিছুকাল আগে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের বালু গাং-এর তলদেশ থেকে প্রাক নব্য-প্রস্তর ও নব্যপ্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যযুক্ত অশ্মীভূত কাঠের বহু হাতিয়ার প্রাপ্তিতে জয়ন্ত সিংহ রায় মনে করেন এখানে অশ্মীভূত কাঠের হাতিয়ার তৈরির কারখানা ছিল৷৩ উয়ারী ও কামরাব থেকে প্রাপ্ত বাটালি দুটি খুব সম্ভব কোন আদিবাসী দ্বারা এখানে আনীত হয়েছিল৷ উয়ারী থেকে ক্লে স্টোন (Clay Stone) দ্বারা নির্মিত অগ্রভাগ ভোঁতা একটি বাটালি, শিবলিঙ্গ ও অত্যন্ত পাতলা গড়নের মৃত্পাত্র প্রাপ্তিতে ধারণা হয় এখানকার জলাভূমির তলদেশে প্রাপ্তব্য ক্লে স্টোন দ্বারা এগুলো তৈরী করা হয়েছিল৷ রামুর বৌদ্ধ বিহারে ক্লে স্টোনের তৈরি একটি মূর্তি রক্ষিত আছে৷৪ পুকুর ও অন্যান্য খননে নীচের স্তরে এ জাতীয় পাত্রের ভগ্নাংশ দেখা যায়৷ লাল ও কাল মসৃণ মৃত্পাত্রের তুলনায় সংখ্যায় এগুলো খুবই কম৷ উয়ারী-বটেশ্বর ও সনি্নহিত প্রত্নস্থল থেকে লৌহনির্মিত বহুসংখ্যক কুড়াল (সংখ্যা প্রায় দু'হাজার), বর্শাফলক, দা, বাটালি, ছুরি, খন্তি, পেরেক সংগৃহীত হয়েছে৷ এগুলো নব্যপ্রস্তর যুগের শেষপাদের নিদর্শন বলে অনুমান করা যায়৷ এপর্যন্ত বঙ্গ ভারতের অন্য কোন প্রত্নক্ষেত্রে অনুরূপ আকৃতির লৌহনিদর্শন পাওয়া যায়নি৷ ত্রিকোণাকার প্রতিটি লৌহ কুঠারের ওজন দেড় থেকে তিন কিলোগ্রাম, পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, আড়াই থেকে তিন ইঞ্চি পুরু, চৌফলা আকৃতির একটি মাথা ক্রমান্বয়ে সরু হয়ে অগ্রভাগ তীক্ষ্ন হয়েছে৷ স্থানীয় চাষীরা চাষাবাদের কাজে বা মাটি খননকালে এগুলো পেয়েছে৷ এগুলো মাটির নীচে একত্র স্তূপীকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়৷ একত্র স্তূপীকৃত অবস্থায় এপর্যন্ত কুঠার প্রাপ্তিস্থলের সংখ্যা বটেশ্বর গ্রামে ১৯টি, বাইঙ্গারটেক গ্রামে ৬টি, উয়ারি গ্রামে ৩টি ও সোনারুতলা গ্রামে ১টি৷ কয়েক বছর আগে বটেশ্বর গ্রামের জনৈক কৃষক মাটি খননকালে লৌহকুঠার, বাটালি, বর্শাফলক ও শিলনোড়া স্তূপীকৃত অবস্থায় পেয়েছিল৷ সেই সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল অধুনা-ব্যবহৃত বাটের ছিদ্রযুক্ত একটি বৃৃহত্ লৌহ কুঠার৷ মনে হয় অগ্রগতির বিশেষ ধাপে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে কুঠারটি নির্মিত হয়েছিল_যে-নির্মাণ পদ্ধতিটি এখনো অব্যাহত রয়েছে৷ দশবারো ইঞ্চি লম্বা বর্শা ফলকগুলো পশুশিকার ও আত্মরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হতো৷ আট ও বারো কিলোগ্রাম ওজনের স্থূল দুটো লৌহ নিদর্শন_যেগুলোর তিন পাশর্্ব ছয় ইঞ্চি বর্গাকার এবং দুটো বস্তুরই উপরিপাশর্্ব চোখা৷ চোখা স্থানের মাঝখানে খাঁজ কাটা৷ এদুটো পেটানোর ভারি হাতুড়ি বা পাটাতন হিসাবে ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা করা হয়৷ কিছুকাল আগে বটেশ্বর গ্রামের জনৈক ব্যক্তি কূপের মতো খনিত দেড়মিটার গভীর একটি গোলাকার গর্তের মধ্যে তিনশত লৌহ কুঠার একত্রে সাজানো অবস্থায় পেয়েছিল৷ কুঠারের চোখা অংশটি ভিতরের দিকে সমতলে রেখে বৃত্তাকারে ক্রমান্বয়ে তিনটি সারি সাজিয়ে মধ্যস্থিত ফাঁকা স্থানে রক্ষিত একটিমাত্র কুঠারের চোখা শীর্ষ উপরের দিকে দণ্ডায়মান অবস্থায় রাখা ছিল৷ ঐ রীতিটিতে অমঙ্গল প্রতিরোধে প্রাচীন যাদু বিশ্বাসের পরিচয় পাওয়া যায়৷ দৈনন্দিন ব্যবহৃত জিনিসগুলোর সঙ্গে কুঠার প্রাপ্তিতে অনুমিত হয় এটি কোন আদিবাসীর সমাধিস্থল৷ অদ্যাবধি আলোচ্য প্রত্নস্থলে স্তূপীকৃত অবস্থায় মাটির অভ্যন্তর থেকে লৌহ কুঠার প্রাপ্তির ৩৪টি চিহ্নিত স্থান আদিবাসীদের সমাধিস্থল হবার সম্ভাবনা৷ এই কুঠারগুলোর সঙ্গে প্রত্নপ্রস্তর যুগে-নির্মিত কুঠারের আকৃতিগত সাদৃশ্য বিদ্যমান৷ এ ধরনের কুঠার বঙ্গভারতের অন্যকোন প্রত্নক্ষেত্র থেকে পাওয়া যায় নি৷ দিলীপ কুমার চক্রবতর্ী এই হাত কুঠারগুলোকে হাতিয়ার নির্মাণের কাঁচামাল হিসাবে আনীত লৌহ পিণ্ড (Iron Bloom) হিসাবে বর্ণনা করেছেন৷৫ চক্রবতর্ীর এ ধারণা সত্য হলে বঙ্গভারতের অন্যান্য প্রত্নক্ষেত্রেও অনুরূপ লৌহ পিণ্ডের সন্ধান পাওয়া যেত৷ এখানে প্রাপ্ত প্রতিটি কুঠারের আকৃতি অভিন্ন হওয়ায় এগুলোকে আমদানিকৃত কাঁচামাল হিসাবে গণ্য করা যায় না৷ আদিবাসীরা বাঁশ বা কাঠের দণ্ডের অগ্রভাগে কৌশলে স্থাপিত করে শক্তভাবে বেঁধে কুঠারগুলো যে আত্মরক্ষা ও বন্য পশু শিকারের কাজে ব্যবহার করতো তাতে সন্দেহ নেই৷ যেমন এগুলোর সঙ্গে প্রাপ্ত বর্শাফলকও আত্মরক্ষা ও শিকারের অন্যতম উপকরণ ছিল৷ উয়ারী-বটেশ্বরের অদূরবর্তী রাজারবাগ ও ছোটবন্দ এবং গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার অন্তর্গত লোহাদি গ্রামে লোহার প্রাকৃতিক সঞ্চয় রয়েছে৷ নিকটবতর্ী সঞ্চয় থেকে লোহা আহরণ করে উয়ারী-বটেশ্বরে কি লোহার হাতিয়ার তৈরীর বৃহত্ কামারশালা গড়ে উঠেছিল? স্থানান্তরে রপ্তানীর জন্য কি এগুলো তৈরী হতো? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে বহুকৌণিক বিশ্লেষণী আলোকসম্পাত প্রয়োজন৷ এস. এ. এম জাহান উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত হাত কুঠারের ফটোমাইক্রোগ্রাফিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, নিদর্শনে ধাতুমলের বিন্যাস অত্যন্ত বিশৃঙ্খল_যেখানে স্বাভাবিক ধর্মানুসারে ধাতুমল একটি নিদিষ্ট অভিমুখে সমপ্রসারিতভাবে সজ্জিত থাকে৷ ধাতুমলের এই অস্বাভাবিক নিদর্শনটির লৌহ নিষ্কাশন পদ্ধতির প্রাচীনত্বেরই প্রমাণ বহন করে৷৬ ভারতের লৌহ ব্যবহারের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন৷ ঋকবেদেও লৌহ ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে৷ এ ব্যাপারে ইতিহাসবিদ আব্দুল হালিম বলেন, 'নবোপলীয় সমাজ অকস্মাত্ স্বীয় উদ্যোগে লৌহযুগের সংস্কৃতির সূচনা করল এ অনুমানের চেয়ে বাইরে থেকে লৌহ যুগের কারিগরী জ্ঞান ভারতে আনীত হয়েছিল এ অনুমান বাস্তবের সঙ্গে অধিকতর সঙ্গতিপূর্ণ৷ একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে ১০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে আগত ইন্দো-ইরানীয় ভাষাভাষী আক্রমণকারীদের শেষ পযর্ায়ের অভিযানের সঙ্গে এদেশে লোহার প্রাথমিক প্রচলনের ঘটনাটি জড়িত'৷৭ উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত স্বল্পমূল্যবান পাথরের গুটিকা, কাচের গুটিকা, ছাপাংকিত রৌপ্য মুদ্রা, উচ্চ মাত্রায় টিন মিশ্রিত ব্রোঞ্জ নির্মিত নব্-যুক্ত পাত্র, উত্তর ভারতীয় মসৃণ কালো মৃত্পাত্র প্রভৃতি নিদর্শনগুলোকে প্রত্নতাত্তি্বকগণ খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক পর্যন্ত কালসীমায় ব্যবহৃত হয়েছিল বলে ধারণা করেছেন৷ উপরিউক্ত নিদর্শনগুলোতে যে-ধরনের কারিগরী দক্ষতা অনুসৃত হয়েছে, লৌহনির্মিত নিদর্শনগুলোতে সে-ধরনের কারিগরী দক্ষতার অভাব পরিলক্ষিত হয়৷ সে-বিবেচনায় খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে এগুলো নির্মিত ও ব্যবহৃত হবার সম্ভাবনা৷ মহেনজোদাড়োতে প্রাপ্ত কুঠারেও বাট লাগাবার ছিদ্র দেখা যায় না, খুব সম্ভব বাট লাগাবার ছিদ্রহীন কুঠার তৈরীর পদ্ধতিটি ইন্দো-ইরানীয় প্রভাবে পূর্ব ভারতেও বিস্তৃতি লাভ করেছিল৷ স্বল্পমূল্যবান পাথরের গুটিকা মানুষের সৌন্দর্যপিপাসা অন্তহীন৷ বিধিদত্ত সৌন্দর্যে চিরঅতৃপ্ত মানুষ নিজেকে বিবিধ অলংকারে, সাজসজ্জায়, প্রসাধনে অপরূপ করে তুলতে নিরন্তর আগ্রহী৷ অঙ্গসজ্জা দ্বারা নিজেকে বিভূষিত করার প্রবণতা সেই আদিযুগ থেকেই চলে আসছে৷ স্বল্পমূল্যবান পাথরে তৈরী গুটিকা অঙ্গসজ্জায় ব্যবহৃত একটি প্রাচীন অলংকার৷ উয়ারী, বটেশ্বর, রাইঙ্গারটেক, সোনারুতলা ও কান্দুয়া গ্রামে প্রচুর পরিমাণে পাথরের তৈরি গুটিকা পাওয়া গিয়েছে এবং এগুলোর প্রাপ্তিস্থল হিসেবে স্থানটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্র রূপে চিহ্নিত হয়েছে৷ উয়ারি-বটেশ্বর সনি্নহিত আড়িয়াল খাঁ তীরবতর্ী বেলাব, উজলাব, আমলাব, পোড়াদিয়া, চণ্ডিপাড়া, মরজাল, বটিয়ারা, কামারটেক, টঙ্গিরটেক, দক্ষিণধুরু প্রভৃতি গ্রামেও অল্প পরিমাণ গুটিকা পাওয়া যায়৷ সাধারণত কর্ষিত ভূমিতে প্রবল বৃষ্টিপাতের পর এগুলো পাওয়া সহজ হয়৷ স্থানীয় লোকেরা এগুলোকে 'সোলেমানী' বলে৷ ভারতেও মধ্যযুগ থেকে মধ্যম আকৃতির গোলাকার গুটিকাগুলোকে মুসলিম ফকিরেরা 'সোলেমানী' বলে অভিহিত করে আসছে৷৮ এখানকার মুসলমানেরা পবিত্র বস্তু হিসাবে সুতায় গেঁথে তজবিহ্রূপে এগুলো ব্যবহার করে৷ স্থানীয় কিংবদন্তী এই যে, হজরত সোলেমান প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর একটি করে তজবিহ্ শয়তান তাড়ানোর উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারতেন৷ স্থানীয় হিন্দুরাও এগুলোকে পবিত্র মনে করে৷ 'জহর মরা' নামে এক বিশেষ ধরনের গুটিকা-ভিজানো পানি সর্বরোগ নিরাময়ের ঔষধ হিসাবে স্থানীয় লোকজন ব্যবহার করে৷ আঞ্চলিক ভাষায় 'চৌখ্যা গুডা' (Eye Beads) নামের গুটিকা গলায় ঝুলিয়ে রাখলে অনিষ্টকারী ভূতপ্রেত থেকে শিশু রক্ষা পায়, এরূপ বিশ্বাস রয়েছে৷ স্বল্পমূল্যবান পাথরের গুটিকা তৈরিতে বিভিন্ন প্রকার পাথর ব্যবহৃত হয়েছে৷ উয়ারি বটেশ্বরে প্রাপ্ত গুটিকাগুলো নিমর্াণে এ্যাসেইট, কার্নেলিয়ান, এ্যাগেইট চেলসেডোনী, অনিক্স, লাল ও সবুজ জেসপার, কোয়ার্টজ, স্মোকী কেয়ার্টজ, মিল্কী কোয়ার্টজ, মার্বেল, গার্নেট, কৃস্টাল, চার্ট, হোয়াইট পেস্ট, রেডস্টোন, গ্রানাইট, বেলে পাথর, এ্যামেথিস্ট প্রভৃতি পাথর ব্যবহৃত হয়েছে৷ গুটিকাগুলো বিভিন্ন আকারে কাটাই করা হয়েছে৷ মূল পাথর কেটে এগুলো তৈরি বলে কোনটিই অন্যটির মত হুবহু এক রকম নয়৷ এখানে প্রাপ্ত গুটিকাগুলোর আকার নিম্নরূপ_চাকতি (Disc) আকৃতি তিন ধরনের যেমন লম্বা, মধ্যম, হ্রস্ব৷ গোলাকার (Barre) ব্যারেল আকৃতি তিন ধরনের, যেমন_লম্বা, মধ্যম, হ্রস্ব৷ গোলাকার (Spherical), নলাকার (Cylindrical), ত্রিকোণাকার (Trigona), বর্গাকার (Cube), পঞ্চভুজাকার (Pentagonal), ষড়ভুজাকার (Hexagonal), আয়তাকার (Rectangular), ডিম্বাকার (Oval), মোচাকার (Conical), দ্বিমুখো মোচাকার (Biconical), যবাকার (Lenticular), তরমুজ আকার (Melon shaped), লজেন্স আকার (Lozenge shaped), হীরক আকার (Diamond shaped), কমলালেবু আকার (Oblatre shaped), কোণহীন ঘনক্ষেত্র (Cornerless cube), বটিকা আকার (Tablet), অর্ধচন্দ্রাকার (Cresent shaped), পিরামিড আকার (Pyramid shaped), উষ্ট্রের কুঁজ (Camel Hump), ফোঁটাকার (Drop pandants), কুঠারসদৃশ (Axe Amulate), দন্তাকার (Tooth shaped), কামরাঙ্গা ফলাকৃতি (Carambula shaped), একাধিক ছিদ্রযুক্ত (Spacer), টোগল (Toggle), গলদেশযুক্ত বল আকৃতি (Collered Ball), তারকা আকৃতি (Star Bead), পাখি আকৃতি (Bird Pendant), বেঙগুটিকা (Frog Bead), বহুপাশর্্বযুক্ত (Multifacited), চক্ষুসদৃশ (Eye Bead), প্রভৃতি৷ গুটিকাগুলো তৈরির বিভিন্ন পযর্ায়ে অত্যন্ত নিপুণ ও রুচিসম্মত প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়েছে৷ কোন কোন গুটিকার কাটাই হীরকখণ্ডের মত, কুলবীচিসম ক্ষুদ্র প্রস্তর খণ্ডে ১২টি অথবা ২৪টি সমবাহু ত্রিভুজ কাটাই, কোনটিতে চিরস্থায়ী সাদা ও হলদে রং দ্বারা রেখা ও নকশার অলংকরণ, পালিশ করা, সূক্ষ্ম ছিদ্রকরণ প্রভৃতি পর্যায় নির্মাতাদের সুকুমার শিল্পচাতুর্য ও উন্নত প্রযুক্তির পরিচয় বহন করে ৷ মালা গাঁথার প্রয়োজনেই গুটিকাগুলোতে ছিদ্র করা হতো৷ ছিদ্রকরণে নানা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়৷ গুটিকায় একই সময়ে দু'প্রান্ত থেকে ছিদ্রকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো তাতে দু'দিকের ছিদ্র প্রায়ই এক সরল রেখা বরাবর মিলিত হতো না৷ ক্ষুদ্র গুটিকাগুলোতে এক পাশর্্ব থেকে হীরকের সরু সুঁই চালিয়ে ছিদ্র সম্পন্ন করা হতো৷ ক্ষুদ্র গুটিকার ছিদ্র অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত, বড় গুটিকার ছিদ্র অপেক্ষাকৃত সরু৷ কোনটির ছিদ্র সরল, কোনটি ধনুকের মতো বাঁকানো, কোনটির ছিদ্রকরণ অসম্পূর্ণ, কোনটি ছিদ্রকরণের বিন্দুবত্ চিহ্ন যা অপর পাশর্্ব ভেদ করে নি, কোনটির যথাস্থানে ছিদ্রকরণ বিফল হওয়ায় পুনঃস্থানান্তরে ছিদ্রকরণ সম্পন্ন হয়েছে৷ একটি আয়তাকার গুটিকায় প্রস্থ বরাবর সমদূরত্বে চারটি ছিদ্র রয়েছে৷ মালায় ব্যবহারের সুবিধার জন্য খুব সম্ভব গুটিকায় এক বা একাধিক ছিদ্র করা হতো৷ তবে একাধিক ছিদ্রযুক্ত গুটিকা (Spacer) অত্যন্ত বিরল৷ গুটিকাগুলো শক্ত সরু সুতায় গেথে গলা, হাত, কোমর, বাজু, নাক, কান, সীমন্ত প্রভৃতি অঙ্গে ব্যবহৃত হতো৷ অঙ্গের শোভাবর্ধন ছাড়াও এগুলো পরিধানের মধ্যে যাদু বিশ্বাস কার্যকর ছিল৷ অপদেবতার কোপ-দৃষ্টি প্রতিরোধক ও মঙ্গলকর এরূপ বিশ্বাসে মানুষ এগুলো অঙ্গে ধারণ করতো৷ গুটিকা কাটাই, পালিশ করা, ছিদ্রকরণ প্রভৃতি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সময় কিছু গুটিকা অকেজো হয়ে যেতো৷ এরূপ অনেকগুলো নমুনা আমরা সংগ্রহ করেছি৷৯ কিছুটা অমসৃণ, ছিদ্রহীন, ছিদ্রচিহ্নযুক্ত ও অসম্পূর্ণ ছিদ্রযুক্ত আকিক পাথরের (Agate) শতাধিক নমুনা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে এগুলো নির্মাণ সমাপ্তের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল বা অন্যকোন বাস্তব কারণে এগুলো পরিত্যক্ত হয়েছে৷ সুচারুরূপে মসৃণ করা এ্যাগেইট, কার্নেলিয়ান, জেসপার, কৃস্টাল, অনিক্স, এ্যামেথিস্ট, গ্রানাইট, মার্বেল, বেলেপাথর, কোয়ার্টজ্ প্রভৃতির অনেকগুলো ছিদ্রহীন গুটিকা প্রমাণ করে উয়ারী- বটেশ্বরে স্বল্পমূল্যবান পাথর গুটিকার নির্মাণকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছিল৷ নক্শাঙ্কিত পাথরের গুটিকা উয়ারী বটেশ্বর প্রত্নক্ষেত্রে কার্নেলিয়ান, এ্যাগেইট, কৃস্টাল প্রভৃতি পাথরের শতাধিক নক্শাঙ্কিত গুটিকা পাওয়া গিয়েছে৷ নক্শা অংকনে সাদা, হলুদ, লাল ও কালো রং ব্যবহার করা হয়েছে৷ তবে লাল ও কালো রং এর ব্যবহার অত্যন্ত বিরল ৷ এখানে প্রাপ্ত গুটিকায় অংকিত নক্শাগুলো হচ্ছে, ব্যারেল বা ডিম্বাকার গুটিকার দু প্রান্তে দুটি করে বলয়ের ভিতরে পরস্পর সংলগ্ন দু'সারি পঞ্চভুজ, গুটিকার দু'প্রান্ত-সীমার দু'টি বলয়াকার সরল রেখার ভিতরে পরস্পর বিচ্ছিন্ন প্রসারিত ফিস বা লুপ (Loop)৷ কার্নেলিয়ান পাথরের গোল বা ব্যারেল আকৃতির গুটিকায় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর (Dot) সমাবেশ, নলাকার কার্নেলিয়ান ও এ্যাগেইট গুটিকার মধ্যভাগে এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ বা সাতটি সমান্তরাল বলয়াকার ডোরা অংকিত৷ চাকতি আকারের কার্নেলিয়ান গুটিকায় বেধ বরাবর একটি বলয়ের অলংকরণ৷ ডিম্বাকার কৃস্টাল গুটিকায় লাল পেইন্টে এক পাশের ছিদ্রের প্রান্তভাগ থেকে বিপরীত পাশের ছিদ্রের প্রান্তভাগ পর্যন্ত তিনটি বলয় দ্বারা সংযুক্তকরণ৷ কার্নেলিয়ান পাথরের আয়তাকার গুটিকার দু প্রান্তে সাদা রেখার বেষ্টনী ও চতুষ্পার্শে তিন সারি oblique চিহ্ন ও ইংরেজী ভি অক্ষর আকৃতির নক্শা ৷ ডিম্বাকার কার্নেলিয়ান ও এ্যাগেইট গুটিকায় তিনটি বলয়, মধ্য বলয় রেখাটি করাতের মত কাটা দিগন্তমুখো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রেখা দ্বারা অলংকৃত৷ তক্তা আকৃতির প্রায় বর্গাকার একটি কার্নেলিয়ান পাথরের গুটিকায় উভয় পাশে দুটি করে বর্গাকার রেখার ভিতরে ক্রস চিহ্ন৷ শেষোক্ত গুটিকাটি উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃত্পাত্র (NBPW) সংস্কৃতিতে অত্যন্ত বিরল৷ তক্ষশিলায় প্রাপ্ত ক্রস প্যাটার্নে অলংকৃত এই গুটিকাটি খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রচলিত ছিল৷১০ NBPW সংস্কৃতিতে (কালসীমা, খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৬৫০) উত্তর ভারতের তক্ষশিলা, তিলওয়ারাকোট, রাজঘাট, শ্রাবস্তী, বৈশালী, আতরাজিখেরা, নেভাসা, হস্তিনাপুর, শোনপুর, কৌশম্বী প্রভৃতি প্রত্নক্ষেত্রে প্রাপ্ত সাদা, কালো ও হলুদ পেইন্টে অলংকৃত গুটিকার সঙ্গে উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত গুটিকার সাযুজ্য রয়েছে৷ এতে বোঝা যায় ঐ প্রত্নক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে সমসাময়িক কালে উয়ারী-বটেশ্বরও অভিন্ন সাংস্কৃতিক আদলে বিকশিত হয়েছিল৷ পাথরের বিষ্ণুপট্ট উয়ারী গ্রামের পশ্চিম পাশর্্ব সংলগ্ন সোনারুতলা গ্রাম থেকে ৫২ী২২ মিলিমিটার আয়তনবিশিষ্ট চার্ট পাথরে তৈরী, মধ্যভাগে অদ্ভুত শিল্পসম্মত খোদাই কাজ করা একটি বিষ্ণুপট্ট পাওয়া গিয়েছে৷ ঘট উপরি দণ্ডায়মান মূর্তির ডান হাতে খড়গ্ ও বাম হাতে চক্র শোভিত৷ মূর্তিটি চেপ্টা নাক ও পুরু ঠোঁট বিশিষ্ট, মাথায় চোঙা আকৃতির শিরস্ত্রাণ/মুকুট, কানে বড় ধরনের ঝুলন্ত দুল রয়েছে৷ পাদপদ্মের ডানে একজন নারী ও বামে একজন পুরুষ করজোড়ে প্রণতিরত৷ নারীর পৃষ্ঠসংলগ্ন তাল তমাল জাতীয় বৃক্ষ শোভিত হয়েছে৷ খোদিত পট্টটির দৈর্ঘ্যের উপরিভাগের দু'প্রান্তে দু'টি ছিদ্র থেকে মনে হয় এটি রক্ষাকবচ হিসেবে গলায় ধারণ করা হতো৷ অনুপম শিল্পমণ্ডিত এবং অত্যন্ত দুর্লভ এই একক শিল্প নিদর্শনটিকে বিশেষজ্ঞগণ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় তৃতীয় শতকের বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন৷ এই আবিষ্কারটি বাংলার প্রাচীন ইতিহাস আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই৷ খুব সম্ভব মিশরীয় ও ক্রীটান সভ্যতার অতিউন্নত ভাস্কর্যকর্মের প্রভাব এতে প্রচ্ছন্ন রয়েছে৷১১ চক্রবর্তী এটিকে ঘটদেবী এবং মৌর্যযুগের শিল্পকর্ম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন৷১২ চক্রবতর্ীর গবেষণার প্রতি বিনীত শ্রদ্ধা রেখে বলা যায় ঘটদেবীর হাতে চক্র ও খড়গ শোভিত হয় না৷ সুশোভন চক্র বিষ্ণু দেবতার হস্তস্থিত আয়ুধ৷ মূর্তির পাদপদ্মে ঘটসদৃশ ডিজাইনটি শোভন ভিত্তিস্তম্ভ হিসাবে দৃশ্যমান হয়৷ বুলবুল আহমেদ ভারতের রূপার প্রত্নক্ষেত্রে প্রাপ্ত রিংস্টোনের একটি প্রতিকৃতির সাথে উয়ারির রক্ষাকবচটিতে উত্কীর্ণ একটি পাশ্বর্ীয় প্রতিকৃতির প্রায় হুবহু সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন৷ রক্ষাকবচটিতে উত্কীর্ণ তুরাইন, ত্রিস্কোলিস উভয় প্রতীক মৌর্য কালপর্বের ছাপাঙ্কিত মুদ্রায় লক্ষ্য করা যায়৷ উয়ারি-বটেশ্বর অঞ্চলে প্রাপ্ত ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রায় তুরাইন প্রতীকটিকে শনাক্ত করা গিয়েছে৷ এসকল তথ্য মৌর্য শিল্পকর্মের সঙ্গে উয়ারির রক্ষাকবচটির সাদৃশ্য ও সময়কাল সংক্রান্ত চক্রবতর্ীর অভিমতকে আরো জোরালো করে৷ ভারতীয় উপমহাদেশে অতি প্রাচীন কাল থেকেই দুর্ভাগ্য ও কুদৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য রক্ষাকবচ ব্যবহারের নমুনা পাওয়া গিয়েছে৷ সিন্দুসভ্যতার ছিদ্রযুক্ত বেশ কিছু সিল (Seal)কে গবেষকগণ রক্ষাকবচ হিসাবে বিবেচনা করেছেন৷ আদি ঐতিহাসিক কালপর্বের তক্ষশিলা, কৌশ্বাম্বী, কোণ্ডাপুর, প্রকাশ প্রভৃতি প্রত্নক্ষেত্র থেকে বিভিন্ন আকৃতির রক্ষাকবচ পাওয়া গিয়েছে৷ তবে উয়ারিতে প্রাপ্ত রক্ষাকবচটি তার বিষয়বস্তুর দিক থেকে সম্পূর্ণভাবেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত৷১৩ এই রক্ষাকবচটিকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাপ্ত এই আকৃতির একমাত্র নিদর্শর্ন হিসাবেই বিবেচনা করা হয়৷১৪ উপরিউক্ত রক্ষাকবচটির মত আরেকটি নকশাঙ্কিত প্রস্তরখণ্ড উয়ারিতে পাওয়া গেছে ৷ চার্ট পাথরে খোদাইকৃত নিদর্শনটির আয়তন ৬.৩৫ সে.মি. ী ৫.০৮সে.মি.৷ আংশিক ভগ্ন এই নিদর্শনটিতে দুটি ছিদ্র রয়েছে৷ এটির প্রস্থ বরাবর দু'টি প্রশস্ত সমান্তরাল সরলরেখা খোদিত এবং রেখাদ্বয়ের উভয় পাশে অত্যন্ত নিপুণভাবে সমপরিমাপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃত্তের সারি খোদিত_প্রতি বৃত্তমধ্যে একটি বিন্দু রয়েছে৷ এসকল বৃত্তের বিন্যাস সমান্তরাল সারির সৃষ্টি করেছে৷ এই চারটি সারির তিনটি সারিতে ১২টি করে এবং অপরটিতে ১৫টি বৃত্ত খোদিত৷ একটি ক্ষুদ্র পরিসরে ৫১টি সমমাপের বৃত্তের চারটি সমান্তরাল সারি এক অনিন্দ্যসুন্দর দৃষ্টিনন্দনতার সৃষ্টি করেছে৷১৫ পূবের্াক্ত নিদর্শনটির মতো এটিও রক্ষাকবচ হিসাবে বিবেচ্য৷ দুটি শিল্পকর্মে অভিন্ন পাথর ব্যবহৃত হওয়ায় এবং শিল্পরীতির সাদৃশ্যগত লক্ষণ বিচারে এটিও মৌর্য কালপর্বে উয়ারি-বটেশ্বরে ব্যবহৃত হবার সমূহ সম্ভাবনা ৷ কাচের গুটিকা বা পুঁতি উয়ারী বটেশ্বরে স্বল্পমূল্যের পাথরের গুটিকা প্রচলনের সমকালেই যথেষ্ট পরিমাণ কাচের গুটিকাও ব্যবহৃত হতো৷ ভারত উপমহাদেশে প্রথম কাচের গুটিকার প্রচলন হয় মহেনজোদাড়োতে৷ তাম্রপ্রস্তর যুগে (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ) কর্ণাটকের মাস্কি ও পি.জি. ডাব্লিউ Painted gray ware সংস্কৃতিতে হস্তিনাপুর, আলমগীরপুর, আল্লাপুর থেকে কাচের পুঁতির নমুনা সংগৃহীত হয়েছে৷ কাচের পুঁতি ব্যবহারের ব্যাপক বিস্তার ঘটে NBPW সংস্কৃতিতে৷১৬ বিভিন্ন আকৃতি ও রংয়ের সমাহারে উয়ারি বটেশ্বরে কাচের গুটিকাগুলো তৈরি হতো৷ বর্ণহীন ছাড়াও হালকা সবুজ, গাঢ়লাল, গাঢ়নীল, গাঢ়কালো, অনুজ্জ্বল কালো, লাল, মেটে লাল, হালকা হলদে, হালকা কমলা, গাঢ় কমলা প্রভৃতি রংয়ের গুটিকা এখানে পাওয়া গিয়েছে৷ গুটিকাগুলোর আকার-বৈচিত্রও উল্লেখযোগ্য৷ যেমন গোলাকার, প্রায় গোলাকার, ডিম্বাকার, বলয়াকার, বর্গাকার, পঞ্চভুজাকার, ত্রিকোণাকার, আয়তাকার, ষড়ভুজাকার, চাকতি, নলাকার (লম্বা, মধ্যম ও হ্রম্ব), ষড়ভুজবিশিষ্ট ব্যারেল, ষড়ভুজবিশিষ্ট নলাকার, গোলাকৃতির ডবল হেক্সাগোনাল, কোণহীন ঘনক্ষেত্র, অবতলবিশিষ্ট নলাকার (concave cylinder), উত্তল মোচাকৃতি, দুমুখো মোচাকৃতি (Biconical), লজেন্স আকার, বহুপাশর্্ববিশিষ্ট বক্রাকার প্রভৃতি৷ এখানে প্রাপ্ত কাচের গুটিকার মধ্যে একবর্ণিল (লাল ও কালো) গুটিকার সংখ্যাই অধিক৷ এগুলো গোলাকার, ডিম্বাকার ও হ্রম্ব নলাকার (short cylinder)৷ অসমাপ্ত ছিদ্রযুক্ত লাল বর্নিল ২/৩ টি গুটিকা সংগৃহীত হয়েছে৷ হালকা সবুজ রংয়ের ক্ষুদ্রাকৃতির নিশ্ছিদ্র ২০টি বল এবং একটি বর্ণহীন ও অপরটি সবুজ, দুটি ছিদ্রহীন কানের দুল পাওয়া গিয়েছে৷ এছাড়া ১০/১২টি স্যান্ডউইচড কাচের পুঁতি (Sandwiched glass Beads) সংগৃহীত হয়েছে৷ ছিদ্রচিহৃযুক্ত অসমাপ্ত ছিদ্রযুক্ত সবুজ লাল ও কালোবর্ণের ১২টি গুটিকা পাওয়া গিয়েছে৷ উয়ারী-বটেশ্বরে প্রাপ্ত কাচের গুটিকায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একটি ডিম্বাকার সবুজ গুটিকায় লাঙ্গলের প্রতীক উত্কীর্ণ৷ এছাড়া কয়েকটি লালবর্ণের কাচের গুটিকার অভ্যন্তরে সরু সাদা নল ব্যবহৃত হয়েছে৷ উয়ারি-বটেশ্বরে প্রাপ্ত কাচের অলংকৃত গুটিকাগুলো গোলাকার, ডিম্বকার ও ব্যারেল আকৃতির৷ আলোনিরোধক কাচের অধিকাংশ গুটিকা গোল, ব্যারেল ও নলাকার৷ এগুলোর অলংকরণে সাদা, নীল, হালকা খয়েরি ও লাল রং ব্যবহৃত হয়েছে৷ অলংকরণের রীতি_গোলাকৃতি কালো গুটিকার দুপাশে সাদা রেখার বেস্টনীর মধ্যে পরস্পর সংলগ্ন দু'সারি পঞ্চভুজ৷ লাল গুটিকায় বলয়াকার ডোরা প্যাচানো বা চক্ষুসদৃশ অলংকরণ৷ ব্যারেল আকৃতির গুটিকায় সাদা রংয়ের বেষ্টনী৷ হালকা খয়েরি রং এর ব্যারেল আকৃতির গুটিকার মধ্যভাগে হালকা ছাই রংয়ের ত্রয়ী বেষ্টনী রেখা৷ একটি সবুজ আলোকভেদ্য গুটিকায় হালকা খয়েরী রং দিয়ে দিগন্ত প্রসারিত চারটি রেখা৷ কালো স্যান্ডউইচড গুটিকায় দিগন্ত প্রসারিত খয়েরি বা সাদা পেইন্টেড রেখা৷ উয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত কাঁচের গুটিকাগুলোর মধ্যে একটি বিরল বৈশিষ্ট্যযুক্ত নমুনা- অসমবাহুবিশিষ্ট একটি আয়তাকার সমতল চাকতি আকারের (দৈঘর্্য ২.৭ সে.মি., প্রস্থ ১.৭ সে.মি.) গুটিকাটিতে কোন অলংকরণ নেই৷ এই বর্ণহীন কাচখণ্ডটির দৈর্ঘ্য বরাবর ঈষত্ বক্রাকার দুটি সাদারেখার মধ্যে ০.৯ সে.মি. বিস্তৃত হালকা খয়েরি রংয়ের ফ্লাট৷ নির্মাণ প্রযুক্তিতে অত্যন্ত নিপুণ কারিগরী দক্ষতার স্বাক্ষরবাহী ছিদ্রযুক্ত এই গুটিকাটি খুুব সম্ভব উয়ারি-বটেশ্বরের বহির্বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন৷ এটির সঙ্গে কার্নেলিয়ান পাথরে তৈরি একটি অর্ধচন্দ্র গুটিকা উয়ারি গ্রামের অধিবাসী আঃ সালাম পাঠান মাটি খননের সময় খুঁজে পান৷ একই সঙ্গে তিনি খুঁজে পান হীরকের মতো অতিস্বচ্ছ একটি ফুল আকৃতির ছিদ্রহীন কাচের গুটিকা৷ ফুলটির নিমর্াণ প্রক্রিয়ায় কারিগরের অনুপম সৌন্দর্যবোধ ও শিল্পচাতুর্য পরিস্ফুট হয়েছে৷ একটি অতিস্বচ্ছ নলাকার কাচখণ্ডে (পরিধি ৬.৫ সে.মি. উচ্চতা ২.৫ সে.মি.) ফুলের মটিফ৷ সমতল থেকে দুই বিপরীত পাশ্বর্ে সমদূরত্বে দুটি খাঁজ যা নীচ থেকে ক্রমান্বয়ে প্রসারিত হয়ে উপরের দিকে বিস্তৃত৷ কেন্দ্রে রয়েছে অতি ক্ষুদ্রাকৃতি মোচার শীর্ষের অবয়বযুক্ত কেশর এবং খাঁজকাটা স্থানের উভয় পাশে তিনটি করে মোট ছয়টি পাপড়ির অগ্রভাগ সুতীক্ষ্ন ফলার মত, যা কেন্দ্রস্থিত ক্ষুদ্রকায় কেশর থেকে উপরে উত্থিত৷ দু'রংয়ের দৃষ্টিনন্দন কাচের গুটিকা, কার্নেলিয়ান পাথরে নির্মর্িত অর্ধচন্দ্র গুটিকা ও স্বচ্ছ কাচের ফুল একই স্থান থেকে পাওয়ায় ধারণা করা যায় যে, এখানে পাথর ও কাচের গুটিকা একই কালপর্বে ব্যবহৃত হতো৷ এসব প্রত্নবস্তুর প্রাপ্তিস্থলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এ স্থানটির অতিসনি্নকটে ভূগর্ভে রয়েছে ইটের তৈরি প্রাচীন স্থাপনার চিহ্ন৷ উয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত কয়েকটি ক্ষুদ্রাকৃতি কাচের বল, ছিদ্রচিহ্নযুক্ত, অসমাপ্ত ছিদ্রযুক্ত অল্পসংখ্যক কাচের গুটিকা প্রাপ্তির দ্বারা এখানে এগুলোর নির্মাণকেন্দ্র ছিল এরূপ জোরদার সিদ্ধান্তে আসা যায় না, তবে কুটির শিল্পের অনুরূপে এখানে কাচের পুঁতি তৈরির ব্যাপারটি অসম্ভব নয়৷ প্রত্নবিদ স্লিন ভারতের বহু স্থানে মাটির পাত্রে কাচ গলিয়ে উত্তপ্ত লৌহ শলাকা দ্বারা ছিদ্র করে কাচের গুটিকা তৈরির কথা বলেছেন৷১৭ সমপ্রতি উয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত কাচের পুঁতি নিয়ে একটি প্রত্নতাত্তি্বক সমীক্ষা চালিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক শাহ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান৷ যদিও সীমিতসংখ্যক পুঁতি দ্বারা তিনি তাঁর গবেষণা সম্পন্ন করেছেন তবু তাঁর সমীক্ষায় তিনি উয়ারি-বটেশ্বর প্রত্নক্ষেত্র নিয়ে পাণ্ডিত্যপূর্ণ মতামত উপস্থাপন করেছেন৷ তাঁর মতে উয়ারী-বটেশ্বরে-প্রাপ্ত স্যান্ডউইচড কাচের পুঁতি (Sandwiched glass Beads), স্বর্ণাকৃত কাচের পুঁতি (Goldfoil Glass Beads), প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের একবর্ণিল টানা কাচের পুঁতি (Indo-pacific Monochrome Drawn Glass Beads) তাত্পর্যপূর্ণ৷ পিটার ফ্রান্সিস জুনিয়র-এর মত প্রকাশ করে তিনি বলেন স্যান্ডউইচড কাচের পুঁতি মধ্যপ্রাচ্য (মিশর ?) থেকে আমদানী হয়েছিল৷ অনুরূপ কাচের পুঁতি পাওয়া গিয়েছে দক্ষিণ ভারত, উত্তর ভারত এবং থাইল্যান্ডের অনেক প্রত্নস্থলে৷ সমপ্রতি মহাস্থানগড়েও এ ধরনের পুঁতি পাওয়া যায়৷ স্যান্ডউইচড কাচের পুঁতির অবস্থিতি উয়ারী-বটেশ্বর এবং রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগের কথা বলে৷ রোমানরা স্বর্ণাকৃত কাচের পুঁতি তৈরীর কৌশল আবিষ্কার করেছিল এবং তাদের বাণিজ্যের প্রসারের ফলে তা ভারতে পরিচিতি লাভ করে এবং পরবর্তীকালে দক্ষিণ এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় তামিল অভিবাসীদের শিল্পকর্মে তা দেখা যায়৷ দক্ষিণ ভারতের আরিকামেদুতে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় ৩০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালে পুঁতিগুলো প্রথম তৈরী হয়৷ উয়ারী বটেশ্বরে অনুরূপ কাচের পুঁতি প্রাপ্তি প্রত্নস্থানটিকে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের একবর্ণিল টানা কাচের পুঁতির এক বৃহত্ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত করেছে৷১৮ কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের জীবন-জীবিকার সঙ্গে লাঙ্গল ঘনিষ্ট ভাবে সম্পর্কিত৷ উয়ারীতে প্রাপ্ত সবুজ কাচের গুটিকায় লাঙ্গল প্রতীক উত্কীর্ণ হবার ব্যাপারটি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ৷ তাত্পর্যপূর্ণ একারণে যে, বঙ্গভারত উপমহাদেশের অন্য কোন প্রত্নক্ষেত্রে প্রাপ্ত গুটিকায় এরূপ প্রতীক অংকনের কথা জানা যায় না৷ খুব সম্ভব এটি স্থানীয়ভাবে নির্মিত এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলনযুক্ত৷ লাঙ্গল প্রতীকটিতে ধর্মীয় বিশ্বাস বিশেষতঃ শিব বা বলরামের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সম্ভাবনা অধিক৷ বলরামের প্রধান আয়ুধ হচ্ছে হল্ বা লাঙ্গল৷ বোঝা যায় যে, এখানে প্রাপ্ত ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রায় এবং সমপ্রতি আবিষ্কৃত শিবনৈবেদ্য পাত্রেও লাঙ্গল প্রতীক উত্কীর্ণ হওয়ায় তত্কালীন কৃষিজীবী গ্রামীণ সমাজের জীবনাচরণ ও ধর্মাচরণ একই সেতুবন্ধনে আবদ্ধ ছিল৷ ফুলের প্রতীকে নির্মিত কাচের গুটিকাটি খুব সম্ভব নৈবেদ্য পাত্রের উপচার হিসেবে ব্যবহৃত হতো৷ কুটির শিল্প হিসেবে উয়ারী-বটেশ্বরে একবর্ণিল টানা কাচের পুঁতি তৈরীর ব্যাপারটি পুরোপুরি নাকচ করা যায় না৷ কিছু ছিদ্রহীন ও অসম্পূর্ণ ছিদ্রযুক্ত গুটিকার নমুনা প্রাপ্তি কুটির শিল্প হিসেবে তৈরীর ইঙ্গিত বহন করে৷ উয়ারীতে প্রাপ্ত সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির ছিদ্রহীন ও ছিদ্রযুক্ত গুটিকা দুটির ওজন যথাক্রমে দুই মিলিগ্রাম ও তিন মিলিগ্রাম৷ এখানে প্রাপ্ত কাচের পুঁতি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের গবেষণার সুযোগ রয়েছে৷ রহমান আশা প্রকাশ করে বলেছেন উত্খননের মাধ্যমে কাচের পুঁতি সংগ্রহ, আঞ্চলিক সংগ্রহের সমস্ত পুঁতি পরখ করা, এবং রাসায়নিক ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগে রহস্যময় উয়ারী-বটেশ্বরকে অধিকতর জানা সম্ভব হবে৷১৯ একটি সাধারণ জরিপে দেখা গেছে উয়ারী, বটেশ্বর, রাইঙ্গারটেক, সোনারুতলা, বেলাব, কান্দুয়া, আমলাব প্রভৃতি গ্রামের অধিবাসীদের কাছে অর্ধ সহস্রের মত মালা রয়েছে৷ প্রতিটি মালায় গুটিকার সংখ্যা ১০১টি বা তদুধর্্ব৷ এগুলো ৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি ক্ষুদ্র-পরিসর অঞ্চল থেকে সংগৃহীত৷ এখান থেকে গত কয়েক শতক ধরে বিপুলসংখ্যক পাথর ও কাচের গুটিকা সংগৃহীত হয়েছে৷ এ অঞ্চলে অর্ধসমাপ্ত, ছিদ্রহীন, ছিদ্রচিহ্নযুক্ত, অনেক ভেঙ্গে-যাওয়া গুটিকা এবং গুটিকা তৈরীর উপযোগী বিভিন্ন রকম পাথর, যেমন এ্যাসেইট, রেড জেসপার, ক্রিস্টাল, বেলে পাথর, কোয়ার্টজাইট, গ্রানাইট, মিল্কী চার্ট ইত্যাদি এবং অশনাক্তকৃত নানা রকম প্রস্তর খণ্ড সংগৃহীত হয়েছে৷ এ সব নিদর্শন প্রাপ্তির ভিত্তিতে বলা যায় উয়ারী-বটেশ্বরে স্বল্প মূল্যের পাথরের গুটিকা তৈরীর কারখানা স্থাপিত হয়েছিল৷ গুটিকা তৈরীর কাঁচামাল ভারতের বিভিন্ন প্রাপ্তি উত্স থেকে এনে এখানেই এগুলো নির্মাণের পদ্ধতিগত বিভিন্ন পর্যায়গুলো সম্পন্ন করা হতো৷ নচেত্ অসম্পূর্ণ বা ভগ্ন টুকরাগুলো দূর থেকে এখানে আমদানী করার কোন হেতু থাকতে পারে না৷ ছাপাঙ্কিত রৌপ্য-মুদ্রা উয়ারী-বটেশ্বরে প্রচুর ছাপাঙ্কিত রৌপ্য-মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে৷ ১৯৩৩ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত উয়ারী গ্রামের ৮টি স্থান থেকে মৃত্পাত্রে সঞ্চিত মুদ্রা (Hoard) পাওয়া যায়৷ সত্তরের দশকে উয়ারী গ্রামের জাঁডু নামক জনৈক ব্যক্তি মাটি খননকালে একটি কালো মৃত্পাত্রে রক্ষিত মুদ্রা (নয় সের পরিমাণ, যা সংখ্যায় চার হাজারের মত) খুঁজে পায়৷ সমপ্রতি ঐ প্রাপ্তিস্থলের অতিসনি্নকটে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ইটের স্থাপনার অবশেষ দৃষ্ট হয়৷ উয়ারী গ্রাম ছাড়াও নরসিংদী জেলার বেলাব, কান্দুয়া, মরজাল, যোশর, কুন্দারপাড়া, জয়মঙ্গল, চণ্ডীপাড়া, পাটুলি, চুলা, হাড়িসাঙ্গান, গোতাসিয়া, ব্রাহ্মণেরগাঁও প্রভৃতি গ্রামসমূহের এক বিস্তীর্ণ পাহাড়িয়া অঞ্চল জুড়ে গত অর্ধশতাব্দী ধরে কৃষকের ভূমি খননকালে বহু ছাপাঙ্কিত মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে৷ বাংলাদেশে উয়ারী-বটেশ্বর ছাড়া বগুড়ার মহাস্থানগড়, রাজশাহীর বাইগাছা ও ফেটগ্রাম থেকে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া গেছে৷ উয়ারীর মুদ্রাগুলো গোলাকার, উপগোলাকার, চতুভর্ুজ, পঞ্চভুজাকার ও আয়তাকার বার (Bar) আকৃতির৷ ছোট মুদ্রাগুলো পুরু ও অপেক্ষাকৃত উত্কৃষ্ট মানের রূপায় প্রস্তুত৷ বড়গুলো পাতলা ও ভঙ্গুর এবং তাতে রৌপ্য উপাদানের পরিমাণ কম৷ অল্পপরিসর দূরত্বে দুটি স্থানে দু'রকমের মুদ্রা প্রাপ্তি খুব সম্ভব এগুলো ব্যবহারের দুটি কাল নির্দেশ করে৷ ছোট আকৃতির মুদ্রার প্রতীক অংকনে আনাড়ীপনা লক্ষণীয়৷ পাতলা ও আকৃতিতে বড় মুদ্রাগুলোর কোনটি নিকৃষ্ট মানের রূপায় তৈরি হলেও প্রতীক অংকনে দক্ষতার পরিচয় রয়েছে৷ এগুলোতে সূর্য, হাতি, তীর, গরু, গাছ, লতাপাতা, হরিণ, ফুল, পেচক, কচ্ছপ, বৃশ্চিক, কুমীর, চিংড়ি, নৌকা, মাছ, বড়শিবিদ্ধ মাছ, লাঙ্গল, চন্দ্র্র, চাকা, দেবতা, বীণা, ত্রিশূল, হাতিয়ার, ষোলঘুটি খেলার ছক (মুদ্রাটি বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘরে রক্ষিত); ত্রিখিলান, ত্রিনরনারীর মূর্তি প্রভৃতি প্রতীক অংকনে পারদর্শিতা উল্লেখযোগ্য৷২০ প্রাচীন মুদ্রার নাম পুরান বা ধরন৷ তাম্র মুদ্রার নাম কাষর্াপণ৷ কেমব্রিজের অধ্যাপক ই. জে. রেপশন বলেন, প্রাচীন ভারতীয় মুদ্রা বিদেশীয় প্রভাবে উদ্ভূত হয় নি৷ এই জাতীয় মুদ্রা রৌপ্যের পাত কেটে রজতখণ্ড নির্মিত হয়েছে৷ পরে উভয় পাশ্বর্ে এক বা একাধিক ছাপ (Punch Mark) দেওয়া হয়েছে৷ চতুষ্কোণ মুদ্রাগুলি অতিপ্রাচীন৷ ফরাসী পণ্ডিত বর্নুফের মতে এই জাতীয় মুদ্রা ভারতের নিজস্ব৷ জাতকমালার গল্পে (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক) কাষর্াপণের উল্লেখ আছে৷ ভিনসেন্ট স্মিথ কাষর্াপণ ও পুরানকে চার ভাগে ভাগ করেছেন_চতুষ্কোণ দণ্ড, বক্রদণ্ড, অসমচতুষ্কোণ ও আয়তাকার৷ ব্যবসায়ীরা রাজার আদেশে এসব নিমর্াণ করতেন৷২১ উয়ারি থেকে ৭ কি.মি. দক্ষিণে মরজাল গ্রামে ছাপাঙ্কিত মুদ্রা প্রাপ্তি প্রসঙ্গে ভট্টশালী বলেন এগুলো আড়িয়াল খাঁ তীরে মৌর্যপূর্ব বা মৌর্য যুগের জনবসতির প্রমাণ৷২২ উয়ারি থেকে ৮ কিমি উত্তরে আড়িয়াল খাঁ তীরস্থ ব্রাক্ষণেরগাঁও (উপজেলা মনোহরদি) ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে৷ উয়ারী, বটেশ্বর, বেলাব, পাটুলি, মরজাল, প্রভৃতি গ্রাম খুব সমভব মৌর্য সাম্রাজ্যের পূর্ব সীমানা নির্দেশ করতো৷ খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে উত্কীর্ণ মহাস্থানগড় শিলালিপিতে গণ্ডক ও কাকনিক নামে দু'প্রকার মুদ্রার উল্লেখ আছে৷ গণ্ডকের সঙ্গে কাকনিকের কি সম্পর্ক ছিল তা জানা যায়নি৷ তবে পরবতীকালে গণ্ডক থেকে গণ্ডা, কাকনিক থেকে কাষর্াপণ বা কাহন ইত্যাদি গণনা প্রচলিত হয়েছে৷ এখনো স্থানীয় অধিবাসীদের গণনা রীতিতে গণ্ডা, কাহন বা পণ প্রচলিত রয়েছে৷২৩ যাকারিয়ার মতে (১৯৮৮) ছাঁচে-ঢালা ও ছাপযুক্ত মুদ্রা এবং স্বল্পমূল্যবান পাথরের গুটিকা প্রভৃতি প্রত্নদ্রব্য দেখে মনে হয় এখানে (উয়ারী-বটেশ্বরে) একটি সমৃদ্ধশালী জনপদের অস্তিত্ব ছিল৷ কারণ ছোট খাট জনপদে এত প্রত্নদ্রব্য থাকার কথা নয়৷ পুণ্ড্রনগর (মহাস্থানগড়) মৌর্যদের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল৷ সেখানে প্রাপ্ত ব্রাক্ষ্মী অক্ষরের শিলালিপি তা প্রমাণ করে৷ উয়ারী-বটেশ্বরে মৌর্যদের অসংখ্য প্রত্নদ্রব্য দেখে মনে হয় যে এগুলি খুব সম্ভব পুণ্ড্রবর্ধনের সমসাময়িক৷২৪ উয়ারী বটেশ্বরে প্রাপ্ত ছাপাঙ্কিত মুদ্রায় অংকিত জীবজন্তুর প্রতীক দেখে মনে হয় তত্কালীন অর্থনীতিতে এগুলোর বিশেষ ভূমিকা ছিল এবং কোন কোনটি ছিল তাদের পূজ্য৷ এসব মুদ্রা উত্কীর্ণকারীরা ছিল সর্বপ্রাণবাদে (Animism) বিশ্বাসী৷ প্রতিটি মুদ্রাতেই সূর্য অংকিত৷ এটা প্রাচীন ভারতীয়দের সূর্যোপাসনার প্রমাণ৷ সূর্য বন্দিত দেবতাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়৷ হাতী, ষাঁড়, বৃশ্চিক, সর্প , কুমির, মাছ, কচ্ছপ, গণ্ডার, চন্দ্র, ত্রিশূল, তীর, বৃক্ষ, ফুল, লাঙ্গল, নৌকা, প্রভৃতি পূজ্য প্রতীক বা প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে গণ্য হতো৷ মুদ্রায় উত্কীর্ণ প্রতীকগুলোতে তখনকার রাজা, রাজ্যাঙ্কের সংখ্যা ও গোত্রগত বিশ্বাসের প্রতীক অংকিত হয়েছে বলে মনে হয়৷ প্রায় প্রতিটি মুদ্রায় চক্রের প্রতীক অংকিত৷ মহেনজোদাড়োর কিছু শিলমোহরে অনুরূপ চক্রের প্রতীক খোদিত রয়েছে৷ ত্রিশূলের ছাপ দ্বারা শৈবধর্ম বিশ্বাসের প্রমাণ মেলে৷ অনেক মুদ্রায় তিনটি করে প্রতীক অংকনের বিষয়টি বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে৷ ত্রিশূল ছাড়াও একটি চক্রের চতুষ্পাশ্বর্ে ত্রিচক্র ও তিনটি তীর, ত্রিপত্রবিশিষ্ট বৃক্ষ (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর?), ত্রিচন্দ্র ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য৷ প্রাচীন মিশর, গ্রীস, মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধু সভ্যতার নানা নিদর্শনে তিন সংখ্যার প্রাধান্য বা বহুলব্যবহার ছিল৷ গবেষকগণের মতে এটি পবিত্র প্রতীক বা ম্যাজিক নাম্বার৷২৫ উয়ারিতে প্রাপ্ত একটি মুদ্রায় মাংসখণ্ড মুখে কুকুরের একটি প্রতীক রয়েছে৷ প্রতীকটি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের৷ ছাপাঙ্কিত মুখ্যপৃষ্টে উত্কীর্ণ প্রতীকসমূহ উয়ারী-বটেশ্বর হতে সংগৃহীত ছাপাঙ্কিত মুদ্রার ক্ষেত্রে গ্রহণ করলে এটিকে মৌর্য রাজবংশের মুদ্রা হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে৷ মৌর্য বৈশিষ্ট্যযুক্ত সাধারাচক্র ও ত্রিখিলান / পর্বত অতিক্রম্য অর্ধচন্দ্র এবং উপরোক্ত দুটি প্রতীকসহ অশোকের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতীক ক্যাদুকেয়াস উত্কীর্ণ দুটি মুদ্রার ক্ষেত্রে এই অনুমান আরো জোরালো৷২৬ উয়ারীতে এত অধিক সংখ্যক মুদ্রা প্রাপ্তি স্থানটিকে দুর্গনগরী অথবা বাণিজ্য নগরী বা প্রশাসনিক কেন্দ্ররূপে প্রতীয়মান করে, যেখানে টাকশাল থাকার সম্ভাবনা অধিক৷ এখানকার বহির্বাণিজ্যের নিদর্শন পাথর ও কাচের গুটিকা, সমপ্রতি আবিষ্কৃত চুনসুরকির পাকা রাস্তা এবং ভূগর্ভে অন্ততঃ ১৫/২০টি স্থানে ইটের স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ দৃষ্টে নিশ্চিতই ধারণা করা যায় যে, বাংলার আদি ঐতিহাসিক কালপর্বে উয়ারী-বটেশ্বর শিল্প বাণিজ্য এবং প্রশাসনিক কেন্দ্ররূপে এক সমৃদ্ধ নগরীর মযর্াদায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল৷ রিংস্টোন উয়ারী থেকে লালচে বেলে পাথরের তৈরি একটি রিংস্টোনের ভগ্নাংশ পাওয়া গিয়েছে৷ এর ব্যাস ৫.০৮ সেমি৷ এতে কোন ছিদ্র লক্ষিত হয় না৷ এর মাঝখানে পদ্ম উত্কীর্ণ৷ ভারতের মুতর্াজাগঞ্জ, বৈশালী, চিরান্ত, কৌশাম্বী, রাজঘাট, ডিটা, যুশি, মথুরা এবং পাকিস্তানের তক্ষশিলা থেকে এ পর্যন্ত ছিদ্রযুক্ত ৩৩ ও ছিদ্রহীন ৩১, মোট ৬৪টি রিংস্টোন পাওয়া যায়৷ গবেষকগণ মনে করেন এগুলো সম্ভবতঃ ধমর্ীয় উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হতো৷ ভারতবর্ষে-প্রাপ্ত রিংস্টোনসমূহের ভৌগোলিক বিস্তারে দেখা যায় বিহার থেকে গান্ধারা পর্যন্ত প্রসারিত বাণিজ্যপথের ধারে সংশ্লিষ্ট নগরসমূহই এদের প্রাপ্তিস্থান৷ উপমহাদেশে রিংস্টোন ব্যাপ্তির সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় হতে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক পর্যন্ত৷ উয়ারীতে-প্রাপ্ত রিংস্টোনটি উপরোক্ত কালপর্বে ভারতীয় রিংস্টোন সংস্কৃতিতে উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থানকে নিশ্চিত করেছে৷২৭ নব্-যুক্ত পাথরের বাটি (Knobbed Stone Relic Casket) সমপ্রতি সোনারুতলা গ্রাম থেকে লালচে বেলে পাথরে তৈরী নবযুক্ত একটি বাটির ভগ্নাংশ পাওয়া গিয়েছে৷ এই প্রত্নবস্তুটির প্রাপ্তিস্থল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ইতিপূর্বে এখান থেকে অনুপম শিল্পমণ্ডিত একটি বিষ্ণুপট্ট এবং সমাধি সংস্কৃতির হাইটিন ব্রোঞ্জ নব্ড পাত্র পাওয়া গিয়েছিল৷ ক্ষুদ্রাকৃতির পাত্রটির ভিতরকার তলদেশের কেন্দ্রে ঈষত্ উত্থিত একটি বড় বিন্দু, এর চতুষ্পাশ্বর্ে অপেক্ষাকৃত নীচু পটভূমিকায় আরেকটি বৃত্ত এবং এর চতুর্দিকের অপেক্ষাকৃত বড় বৃত্তটি পাত্রের তলদেশের সমতল থেকে ঈষত্ উত্থিত৷ এছাড়া পত্রটির বহির্ভাগের তলদেশে রয়েছে একটি অতিক্ষুদ্র বৃত্ত চিহ্ন৷ অতঃপর ক্রমান্বয়ে বড় আকৃতির তিনটি বৃত্তরেখা, পরে অপেক্ষাকৃত নীচু সমতলে মোটা রেখার একটি বৃত্ত এবং পরবর্তীতে অধিকতর উত্থিত (Bas Relief) আরেকটি বৃত্ত; ক্রমান্বয়ে দুটি বৃত্তরেখার মধ্যে মোটা বৃত্তরেখা৷ সর্বশেষ বৃত্তটি সমতল তলদেশের মধ্যে ঈষত্ উঁচু একটি গোলাকার প্লাটফর্মের প্যাটার্ন তৈরী করেছে৷ নিপুণ হস্তে খোদাইকৃত এ শিল্প নিদর্শনটি খুব সম্ভব বৌদ্ধযুগের সমাধি-সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত৷ ভারতবর্ষে অশোকের রাজত্বকালে (খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-৩৬) সাঁচি, আন্ধার, সাতধারা, ভোজপুর, পিপড়াহুয়া, অমরাবতী প্রভৃতি প্রত্নক্ষেত্রের বৌদ্ধস্তূপসমূহে অনুরূপ সমাধি সংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল৷২৮ এখানে প্রাপ্ত ছাপাংকিত মুদ্রা, পাথর ও কাচের গুটিকা, বিষ্ণুপট্ট, হাইটিন ব্রোঞ্জের নব্যুক্ত পাত্র ইত্যাদি সামগ্রী ব্যবহারের সমসাময়িককালে মৌর্যযুগে খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক পর্যন্ত কালসীমায় এটি ব্যবহৃত হতো বলে ধারণা হয়৷ প্রত্নতাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে কৌতূহলের সঙ্গে অনুধাবনযোগ্য এই শিল্পকর্মটি উয়ারী-বটেশ্বর সম্পর্কিত গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করবে৷ উয়ারীতে প্রাপ্ত রিংস্টোনটি লালচে বেলে পাথর দিয়ে তৈরী৷ এ প্রকার পাথরের দু-একটি খণ্ডাংশ উয়ারীতে পাওয়া গিয়েছে৷ এ থেকে লালচে বেলে পাথর দিয়ে স্থানীয়ভাবে শিল্প নিদর্শন তৈরীর ক্ষীণ আভাস পাওয়া যায়৷ ব্রোঞ্জনির্মিত নব্যুক্ত শিব-নৈবেদ্য পাত্র উয়ারী গ্রামের পূবেরটেকের দক্ষিণ প্রান্তে তিনদিক বিলঝিলবেষ্টিত একটি উপদ্বীপসদৃশ উঁচুভূমিতে কিছুকাল আগে একটি ব্রোঞ্জ শিব-নৈবেদ্য পাত্র পাওয়া গিয়েছে৷ বিলের প্রান্তভাগের ঢালুভূমিতে মত্স্য চাষের জন্য ক্ষুদে পুকুর খননের সময় সমতল থেকে একমিটার গভীরে একত্রে জমানো অবস্থায় অনেকগুলো ব্রোঞ্জ বলয়, জলতরঙ্গ, মল প্রভৃতির সঙ্গে অলংকৃত ও নব্যুক্ত একটি শিব-নৈবেদ্য পাত্র, দুই হাতল-বিশিষ্ট একটি বড় ব্রোঞ্জ পাত্রে রক্ষিত ছিল৷ প্রাকৃতিক বিকারে খুবই নাজুক পাত্রটি খননের সময় টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে যায়৷ শিব-নৈবেদ্য পাত্রটির পরিধি ৩১.৫ সে.মি, ব্যাস ১০.২ সে.মি, উচ্চতা ১ সে.মি৷ পাত্রটির অলঙ্করণে অত্যন্ত উন্নত শৈল্পিক দক্ষতা পরিস্ফুট৷ পাত্রটির কেন্দ্রস্থলে উত্থিত নব্-এর চতুর্দিকে একটি বৃত্ত, অতঃপর অধিক উত্থিত (Bas Relief) মোটা রেখার বৃত্ত ক্রমান্বয়ে বড় হয়ে-যাওয়া তিনটি বৃত্তের মধ্যবর্তী স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তির্যক রেখার অলঙ্করণ৷ অতঃপর অপেক্ষাকৃত বিসতৃত পটভূমির ঊধর্্বাংশে ডানে শিব, বামে তাঁর বাহন বৃষ৷ শিবের পদপ্রান্তে গণেশ ও তাঁর বাহন মূষিক৷ শিবের পাদপদ্মের উপরে সুচারু দক্ষতায় লাঙ্গলের প্রতীক উত্কীর্ণ হয়েছে৷ পাত্রটির পটভূমিতে মূল প্রতিপাদ্য উত্কীর্ণ করার পর পুনঃ ঈষত্ দূরত্বে তিনটি বৃত্তের সমাহার এবং দুটি বৃত্তরেখার মাঝখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তির্যক রেখার অলঙ্করণ৷ পাত্রের ঈষত্ উত্থিত স্কন্ধের (Rim) নিম্নে বৃত্তরেখা এবং রেখার বহির্ভাগে কোণাকৃতি নকশার অলঙ্করণ৷ এ ছাড়া মূল পটভূমিতে বহু বিন্দু এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বৃত্ত ও রেখার সুচারু নকশায় নিদর্শনটিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছে৷ পরিতাপের বিষয়, মাটি খননকারী শ্রমিকেরা কোদালের আঘাতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শনটির উন্নত প্রান্তভাগের (Rim) একাংশ নষ্ট করে দিয়েছে৷ নৈবেদ্য পাত্রের সঙ্গে বিভিন্ন আকৃতির অর্ধশতাধিক ব্রোঞ্জ বলয় (বড় আকৃতির একটি বলয়ের ওজন ৫০০ গ্রাম), হাইটিন ব্রোঞ্জ পাত্রের টুকরো, আরো দুটি পাত্রের উন্নত প্রান্তভাগের ভাঙ্গা টকুরো দেখে ধারণা হয় আদি ঐতিহাসিক কালপর্বে এখানে কোন ধনাঢ্য শিবভক্ত সমাহিত হয়েছিলেন৷ ইতিপূর্বে উয়ারী (সোনারুতলা) গ্রামে প্রাপ্ত নব্যুক্ত হাইটিন ব্রোঞ্জ পাত্রটির প্রাপ্তিস্থলকে কোন আদিবাসীর কবর বলে ধারণা করেছিলাম৷২৯ বাসা ও রহমান৩০ নব্যুক্ত পাত্রটির গবেষণায় বলেছেন, আদি ঐতিহাসিক কালপর্বে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারত উপমহাদেশের বাণিজ্যের নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল৷৩১ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন উপরিউক্ত নিদর্শনগুলোর প্রাপ্তিস্থলের খুব নিকটেই চারপায়াযুক্ত একটি শিল ও প্রচুর সংখ্যক ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল৷ প্রাপ্ত শিলটি ধর্মীয় শিল্পকলার নিদর্শন৷ এতে স্বস্তিকা ও ত্রিরত্ন প্রতীক অংকিত৷ স্বস্তিকা চিহ্নটি মঙ্গলদায়ক হিসেবে মহেনজোদাড়ো, হরপ্পা বা পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও ব্যবহৃত হতো এবং ত্রিরত্ন প্রতীকটি বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ এই ত্রয়ীর প্রকাশে ব্যবহৃত হয়৷ আদি ইতিহাসপর্বের প্রত্নস্থলগুলোতে ত্রিরত্ন প্রতীক সম্বলিত স্বল্পমূল্যবান পাথরের গুটিকও রক্ষাকবচে অংকিত৷ তক্ষশিলা ও নাসিকে প্রাপ্ত শিল ও বেদীস্বস্তিকা ও ত্রিরত্ন প্রতীকে অলংকৃত করা৷৩১ বেলে পাথরে তৈরী একটি বেদীর সম্মুখভাগের ভগ্নাংশ সমপ্রতি পাওয়া গিয়েছে৷ এতে ত্রিপত্রবিশিষ্ট বৃক্ষ বা ত্রিপাপড়ি-বিশিষ্ট ফুল ও ত্রিরত্ন প্রতীক রয়েছে৷ এই নিদর্শনটিও পূর্বোক্ত শিল/বেদীর সমপর্যায়ভুক্ত এবং বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷ কৌশিক পাত্র ক্ষুদ্রকায় নৌকা আকৃতির ধূসর পোড়ামাটির একটি নিদর্শন (দৈঘর্্য ১০.৭ সে.মি, ব্যাস ৪ সে.মি) উপরিভাগে দৈর্ঘ্য বরাবর সমখাত-বিশিষ্ট তিনটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত৷ এই কৌশিক পাত্রটি দেবদেবীর গায়ে বা মন্দিরে পুণ্যজল ছিটানোর কাজে ব্যবহৃত হতো৷ লিঙ্গ পূজার পোড়ামাটির নিদর্শন রাইঙ্গাইরটেক গ্রাম থেকে পোড়া মাটির ত্রিকোণাকার দুটি ভগ্নাংশ পাওয়া গিয়েছে৷ ওগুলোর মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে একটি ক্ষদ্র্র নালা ক্রমশঃ মসৃণ, সরু ও সংকুচিত হয়ে নীচের দিকে নেমেছে৷ এটা আদিবাসীদের পূজ্য প্রতীক বলেই মনে হয়৷ আদিযুগে মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মাতাই ছিলেন পরিবারের কত্রর্ী, তদুপরি সন্তান উত্পাদন ক্ষেত্র৷ উয়ারী-বটেশ্বর ও সনি্নহিত অঞ্চলে বসবাসকারী প্রস্তর, তাম্রপ্রস্তর ও আদি লৌহ যুগের মানুষেরা সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাসী ছিল৷ তাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে শিবপূজা ছিল অন্যতম৷ বটেশ্বর গ্রামে লোহার হাত-কুড়ালের সঙ্গে প্রাপ্ত পাথর ও পোড়ামাটির শিবলিঙ্গ, মেটে লাল রঙের পোড়া মাটির স্ত্রী-জননেন্দ্রিয় প্রভৃতি প্রতীকগুলো এই ধারণাকে আরো জোরালো করে৷ শিবপূজা ও লিঙ্গপূজা সমার্থক৷ শিবপূজার মত যোনিপূজাও তত্কালে একটি অপরিহার্য ধর্মাচরণ হিসেবে গণ্য হতো৷ চট্টগ্রামের উপজাতিরা এখনো দ্বিশাখা-বিশিষ্ট ডালের পূজা করে৷ এটা তাদের কাছে শিবপূজা নামে অভিহিত৷ দ্বিশাখা-বিশিষ্ট ডাল যোনির প্রতীক৷ মহেনজোদাড়ো ও হরপ্পায় উত্খননে চারপাশে ফুল-অংকিত যোনি পাওয়া গেছে৷ এটি যোনি-পূজারই নিদর্শন বহন করে৷৩২ আদিবাসীরা পদার্থ মাত্রকেই সচেতন জ্ঞান করতো৷ এ বিশ্বাস থেকেই শৈবধর্মের উত্পত্তি৷ অবশ্য বর্তমানের শিব কেবল বৈদিক রুদ্র নহেন, তিনি লিঙ্গ মূর্তিতে পূজিত৷ ভারতীয় অনার্যদের মধ্যে লিঙ্গোপাসনা প্রচলিত ছিল৷ পরে আর্যরা অনার্যদের কাছ থেকে শিবপূজার পদ্ধতি অনুসরণ করে৷ বেদে শিব নামে কোন দেবতা দেখা যায় না, শুধু মঙ্গলকর অর্থে শিব শব্দের প্রয়োগ আছে৷৩৩ শিবপূজার পদ্ধতি ভারতীয়দের নিজস্ব, এজন্য তারা আর্যদের নিকট ঋণী নয়৷ অনার্যসম্ভূত জাতি ডোম, চণ্ডাল, ঋষি, প্রভৃতি জাতিগণ স্বহস্তে শিবের অর্চনা ও নৈবেদ্য দানে অধিকারী, কিন্তু ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য দেবতার পূজা হয় না৷ অনার্য মহাদেব, বৈদিক রুদ্র ও সাঁওতালদের গিরিদেব মূলতঃ অভিন্ন দেবতা৷ মহেনজোদাড়োতে প্রাপ্ত একটি মূর্তির সঙ্গে শিবের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়৷ উয়ারী-বটেশ্বরে আদিবাসীদের মধ্যে শিবপূজা ও যোনিপূজা বহুল প্রচলিত ছিল৷ সমপ্রতি-প্রাপ্ত ব্রোঞ্জ নৈবেদ্য পাত্রে অংকিত বৃষবাহন শিব, মূষিকবাহন গনেশ, বলরাম বা বলদেবের আয়ুধ পৌরাণিক হলধারণ শৈব বিশ্বাসের প্রতীক৷ ছাপাঙ্কিত মুদ্রার অংকিত ত্রিশূল প্রতীকও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য৷ এ ছাড়া উয়ারী-বটেশ্বরে-প্রাপ্ত ত্রিরত্ন গুটিকা, অর্ধচন্দ্রগুটিকা, ছাপাঙ্কিত মুদ্রায় অংকিত বৃষ প্রভৃতি এখানকার প্রাচীন অধিবাসীদের শৈবধর্ম বিশ্বাসের পরিচায়ক৷ ব্রোঞ্জ পাত্রটি নব্যুক্ত হওয়ায় এতে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছাপ প্রতিফলিত হয়েছে৷ একই স্থান থেকে ত্রিরত্ন ও স্বস্তিকাখোদিত প্রস্তর বেদী প্রাপ্তি থেকে বলা যায় আদি ঐতিহাসিক কালপর্বে উয়ারী বটেশ্বরে ধর্মের পারস্পরিক সংমিশ্রণ (aculturation) ঘটেছিল৷ তক্ষশিলায় NBPW সংস্কৃতিতে বৃষ, অর্ধচন্দ্র ও ত্রিরত্ন প্রতীকযুক্ত পাথরের গুটিকা প্রাপ্তি থেকে নীহারিকা মনে করেন শৈব ও বৌদ্ধধর্ম উভয়টিই তক্ষশিলাবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল৷৩৪ উয়ারী-বটেশ্বরে মানব বসতি যে অতি প্রাচীন তাতে সন্দেহ নেই৷ এখানে প্রাপ্ত চারটি পাথুরে নিদর্শন (একটি অশ্মীভূত কাঠের) প্রত্নপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার বলেই মনে হয়৷ বন্যামুক্ত এই ভূখণ্ড মানুষের বসবাসের অনুকূল৷ বনে শিকারের পশু, ফলমূল আর নিকটস্থ জলাভূমি থেকে মত্স্য আহরণ এ দুটি পরিবেশগত সুযোগ আগে থেকেই ছিল৷ নব্যপ্রস্তর যুগের হাতিয়ার-প্রাপ্তির আলোকে বলা যায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে এগুলো এখানে ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে৷ উয়ারী বটেশ্বরে লৌহ কুঠার, বর্শাফলক প্রভৃতি ব্যবহারের সময়কাল এখনো স্থিরীকৃত হয়নি৷ তবে ড. জাহানের রাসায়নিক পরীক্ষার ভিত্তিতে খ্রিস্টপূর্ব ৭০০-খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দের বলে আহমেদ ধারণা করেছেন৷৩৫ ছাপাঙ্কিত মুদ্রাগুলো মৌর্য কালপর্বে (খ্রিস্টপূর্ব ৩২০-খ্রিস্টপূর্ব ১৮৭) প্রচলিত থাকার সম্ভাবনা৷ ভট্টশালী এগুলোকে মৌর্য বা মৌর্য পূর্ববর্তী বলে ধারণা করেছেন৷ যাকারিয়া এই মুদ্রাগুলো খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে প্রচলিত থাকার কথা বলেছেন৷ কাচের গুটিকাগুলো সম্ভবতঃ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল৷৩৬ বঙ্গীয় শিল্পকলা চর্চার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের উদ্যোগে উয়ারীতে প্রত্নতাত্তি্বক উত্খননে প্রাপ্ত উত্তর ভারতীয় কালো মসৃন মৃত্পাত্র, রোলেটেড মৃত্পাত্র, নবড্ মৃত্পাত্র প্রভৃতি প্রত্ননিদর্শন আদি ঐতিহাসিক যুগের৷ তিনটি কার্বন উয়ারীর বসতিকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৫০ অব্দের বলে নিশ্চিত করেছে৷৩৭ চক্রবর্তী টলেমির পেরিপ্লাস অব দি ইরিথ্রিয়ান সি গ্রন্থের বিবরণে উল্লেখিত 'সোনাগৌড়াকে' উয়ারী বটেশ্বরের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন৷৩৮ তিনি উয়ারীর রক্ষাকবচটিকে মৌর্য যুগের শিল্পকর্ম হিসেবে উল্লেখ করেছেন৷ টলেমি উল্লেখিত সৌনাগড়ার সত্যিকার অবস্থান কোথায়? সুবর্ণগ্রাম বর্তমানে সোনারগাঁ নামে পরিচিত৷ স্থানটি নদীবাহিত পলি থেকে উত্থিত চরাভূমি, মধ্যযুগের খ্যাত রাজধানী ও নদী বন্দর৷ সৌনাগড়া বা সুবর্ণগ্রাম বা সোনারগাঁয়ের বিস্তৃতি ছিল সাভার, কাপাসিয়া, বর্মী, শ্রীপুর, টোক, বেলাব, মরজাল, পলাশ, শিবপুর, মনোহরদী, উয়ারী-বটেশ্বরসহ লক্ষ্যা, বহ্মপুত্র, আড়িয়াল খাঁ, মেঘনা প্রভৃতি নদনদী অধু্যষিত এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড৷ উয়ারী-বটেশ্বরে একবর্ণিল টানা কাচের পুঁতি ও স্যান্ডউইচড্ কাচের গুটিকা প্রাপ্তি থেকে ভারতের বিভিন্ন স্থান, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া (থাইল্যান্ড) এবং ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের (রোমান সাম্রাজ্য) বহির্বাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে রহমানও উয়ারী-বটেশ্বরকেই টলেমি উল্লেখিত সৌনাগড়া বলেছেন৷৩৯ উয়ারী-বটেশ্বরে যে নগরের পত্তন হয়েছিল তার আভাস ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ এখানকার ১৫/২০টি স্থানে কৃষকদের মাটি খননকালে বৃহত্ টালি নির্মিত স্থাপনার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে৷ এর একটি স্থানের ইট পরীক্ষা করে দেখা যায় ধানের তুষ মিশিয়ে এগুলো তৈরী হয়েছে৷ বটেশ্বর গ্রামে পুকুর খননে প্রাপ্ত বৃহত্ মট্কি (ধান্যাদি রাখার বড় মৃত্পাত্র) নির্মাণে পাত্রের বহির্দেশে ধানের তুষের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে৷ মেটে লাল রঙের মৃত্পাত্রটি হাতে তৈরী৷ এ ছাড়া দু' হাতলযুক্ত একটি বৃহত্ পাত্রের স্কন্ধ (Rim) অলঙ্করণে সরল রেখা ও ক্রস চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল পোড়া মাটির তৈরী দুটি স্ত্রী-জননেন্দ্রিয়৷ তিন পায়া-বিশিষ্ট ১২/১৪ সে.মি. উঁচু বসার গোলাকার পিঁড়ি, জলকান্দা, শিবলিঙ্গ প্রভৃতি হাতে তৈরী ও মেটে, লাল ও কালো রঙের৷ সমপ্রতি সোনারুতলা গ্রাম থেকে একটি পাথরের ও একটি পোড়ামাটির নিবেদন-স্তূপ (Votive Stupas) পাওয়া যায়৷ এগুলোর নির্মাণ পদ্ধতি, অলঙ্করণ এবং পোড়ানোতে কারিগরী জ্ঞানের অদক্ষতায় ধারণা হয় এগুলো তাম্র প্রস্তর যুগে ব্যবহৃত হতো৷ পশ্চিমবঙ্গের পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে তাম্রাশ্মীয় পর্বে (১৬০০-১৪০০ খ্রিস্টপূর্ব) বসতি স্থাপনকারী মানবগোষ্ঠী ধান্য তুষের ছাপ সংবলিত ধূসর, রক্তিম ও কৃষ্ণবর্ণের মৃত্পাত্র নির্মাণ করেছে৷৪০ কাদামাটিতে ধান বা ধানের তুষ মিশিয়ে ইট ও মৃত্পাত্র নির্মাণের ঐতিহ্য বহু প্রাচীন৷ এখানকার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে ঘরের মাটির দেওয়ালে কাদার সঙ্গে তুষ মিশিয়ে শক্ত প্রলেপ দেবার বহু প্রাচীন রীতিটি এখনো অব্যাহত রয়েছে৷ বঙ্গ ও সমতটে ইট, পাথর দুর্লভ বিধায় এখানে গৃহ নির্মাণে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে কাঠ, বাঁশ ও কাদামাটি৷ কাদামাটি দিয়ে দেওয়াল নির্মাণের পদ্ধতিটি খুবই প্রাচীন বলে মনে হয়৷৪১ ২০০০ সালে উয়ারী গ্রামে প্রত্নতাত্তি্বক খননে উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃত্পাত্রের স্তর থেকে একটি ধ্বসে-পড়া দেওয়ালের অবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে৷ এটা এ অঞ্চলের দীর্ঘকাল থেকে চলে-আসা গৃহ নিমর্াণ পদ্ধতির সাংস্কৃতিক স্বাক্ষর৷৪২ উয়ারী গ্রামে ৬৩৩ মিটার দীর্ঘ-বাহুবিশিষ্ট বর্গাকৃতি গড় ও পরিখা বিদ্যমান৷ পূর্ব পাশের পরিখাটি ছাড়া গড় ও পরিখার চিহ্ন প্রায় বিলুপ্তির পথে৷ ৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট আরেকটি বহির্দেশীয় গড় ও পরিখা সোনারুতলা গ্রাম থেকে শুরু করে বটেশ্বর, হানিয়াবাইদ, রাজারবাগ ও আমলাব গ্রামের উপর দিয়ে আড়িয়াল খাঁ নদের প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত৷ এটিকে স্থানীয় লোকজন 'অসম রাজার গড়' বলে৷ পরীক্ষা করে দেখা গেছে অভ্যন্তরীণ ও বহির্দেশীয় পরিখার গভীরতা ছিল যথাক্রমে ৩ ও ১২ মিটার৷ এতে বোঝা যায় নিমর্াণকালে বহির্ভাগের গড়ের উচ্চতা অপেক্ষাকৃত অধিক ছিল৷ এরূপ দুটো প্রতিরক্ষা প্রাচীর গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য বা প্রশাসনিক কেন্দ্রের নির্দেশক, যা নগরায়নেরও অন্যতম শর্ত৷ ২০০৩-২০০৫ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উত্খননে সমতল থেকে দুই মিটার গভীর পর্যন্ত একটি ইটের স্থাপনার (দৈঘ্য ৬মি প্রস্থ ৫মি) ভিত্তির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে৷ আবিষ্কৃত এই স্থাপনাটির ভারসাম্য রক্ষণের জন্য ৩২ সারি ইট কৌশলে উপরি উপরি স্থাপিত করে কাদা মাটি দিয়ে প্লাস্টার করা হয়েছে৷ এর পাশর্্ববতর্ী অপর ট্রেঞ্চে উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃত্পাত্র, স্বল্পমূল্যের পাথর ও কাচের গুটিকা, গৃহের ছাদ নিমর্াণের টালি পাওয়া যায়৷ রহস্যময় আকৃতির এই স্থাপনাটির উত্খনন সমাপ্ত হলে উয়ারী-বটেশ্বরে নগরায়নের স্বাক্ষর অধিকতর স্পষ্ট হবে৷ ২০০৪ সালের মার্চ-এপ্রিলে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে উয়ারী গ্রামে খননে আবিষ্কৃত হয়েছে ১৮ মিটার দীর্ঘ, ৬ মিটার প্রশস্ত ও ৩০ সে.মি. পুরু একটি প্রাচীন পাকা রাস্তা৷ রাস্তাটির নির্মাণে ইটের টুকরা, চুন, উত্তর ভারতীয় কৃষ্ণ মসৃণ মৃত্পাত্রের টুকরা ব্যবহৃত হয়েছে, তত্সঙ্গে রয়েছে ল্যাটারাইট মাটির লৌহযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরা৷ ড. রহমান এটিকে আড়াই হাজার বছরের পুরনো বলে দাবি করেছেন৷ এ সম্পর্কে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক দিলীপকুমার চক্রবতর্ীর অভিমত_এত দীর্ঘ ও চওড়া রাস্তা এর আগে পুরো গাঙ্গেয় উপত্যকায় দ্বিতীয় নগরায়ন সভ্যতায় কোথাও আবিষ্কৃত হয়নি৷ গাঙ্গেয় উপত্যকার দ্বিতীয় নগরায়ন বলতে সিন্ধু সভ্যতার পরের নগরায়নের সময়কে বুঝায়৷ ফলে যেটি আবিষকৃত হয়েছে বলা হচ্ছে তা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সিন্ধু সভ্যতার পর ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরনো রাস্তা৷ সিন্ধু সভ্যতায় একই উপকরণের রাস্তা পাওয়া গিয়েছিল৷ পাকিস্তানের তক্ষশিলায় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম থেকে খ্রিস্টাব্দ দ্বিতীয় শতকের রাস্তা পাওয়া গেছে৷ কিন্তু উয়ারীর রাস্তা এর চেয়ে দু'শ বছরের পুরনো৷৪৩ রাস্তাটির প্রাচীনত্ব নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে ভিন্নমত রয়েছে৷ কেউ কেউ এটিকে ঘরের মেঝে বা মাল খালাসের প্লাটফর্ম বলে মত দিয়েছেন৷ কিন্তু রাস্তাটি নির্মাণের ধরন, ব্যবহৃত মালমশলা, দুর্গ প্রাকারের ভিতর থেকে পরিখার প্রান্তসীমা পর্যন্ত এর বিস্তারদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় রাস্তাটি অতিপ্রাচীন এবং দুর্গ প্রাকারে প্রবেশ প্রস্থানের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ৷ রাস্তাটি ছাড়া অপর ট্রেঞ্চে ৩০ সে.মি. নীচে ১০ সে.মি. পুরু একটি ঘরের মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে৷ ইটের টুকরা, সুরকি ও চুন মিশিয়ে মেঝেটি তৈরি৷ এছাড়া পাওয়া গেছে ছাদ নির্মাণের টালি৷ ধারণা করা হচ্ছে রোদে শুকানো কাদামাটির চাঁই দিয়ে ঘরের দেওয়াল, ইট-সুরকি ও চুন দিয়ে মেঝে এবং টালি দিয়ে ছাদ নিমর্াণের রেওয়াজ ছিল৷ মহাস্থানগড়ে এ ধরনের মেঝে পাওয়া গেছে৷ গাঙ্গেয় উপত্যকায় খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের আবিষ্কৃত শহর কৌশাম্বি, চন্দ্রকেতুগড়, শিশুপালগড়, হস্তিনাপুর, অহিচ্ছত্র, শ্রাবন্তী, বৈশালী ও বানগড়ে এ ধরনের মেঝে আবিষ্কৃত হয়েছে৷ ২০০০ সালে নেদারল্যান্ডে কার্বন পদ্ধতিতে তারিখ নির্ণয়ের মাধ্যমে উয়ারী-বটেশ্বর গ্রাম দুটি দেশের সভ্যতার ইতিহাসে প্রাচীন স্থান হিসাবে অবস্থান নিয়ে নেয়৷ সমপ্রতি রাস্তার সন্ধান এ স্থানটির নগরায়ন, বাণিজ্যিক কেন্দ্রের ধারণাকে স্পষ্ট করে তুলছে৷৪৪ আদি ঐতিহাসিক কালপর্বে উয়ারী-বটেশ্বরের অধিবাসীদের ধর্মীয় বিশ্বাস কিরূপ ছিল তা পুরোপুরি জানা যায়নি৷ উয়ারীতে হাইটিন ব্রোঞ্জের নব্ড বাটি-প্রাপ্তি এবং উত্খননে প্রাপ্ত নবড্ মৃত্পাত্র এ অঞ্চলে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ইঙ্গিত বহন করে৷৪৫ উয়ারীতে প্রাপ্ত পাথরের শিল (বেদী?) এর উপরিপৃষ্ঠে স্বস্তিকা ও ত্রিরত্ন চিহ্ন উয়ারী-বটেশ্বরে বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্বের ধারণাকে শক্তিশালী করে৷৪৬ সমপ্রতি প্রাপ্ত পাথরের নবড্ বাটি থেকে নিশ্চিতই বোঝা যায় বৌদ্ধধর্ম ও দর্শনের অনুসারীরা এখানে বসবাস করেছিল৷ ছাপাঙ্কিত মুদ্রার ত্রিশূল প্রতীক শৈবধর্মের পরিচায়ক৷ ব্রোঞ্জ নবড্ নৈবেদ্য পাত্রটিতে শিব-বৃষ, গণেশ-মূষিক ও লাঙ্গল প্রতীক উত্কীর্ণ থাকায় উয়ারী-বটেশ্বরে শৈবধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের পারস্পরিক সহাবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে৷ NBPW সংস্কৃতিতে উভয় ধর্মের এরূপ সহাবস্থান তক্ষশিলায়ও জনপ্রিয় হয়েছিল৷৪৭ খুব সম্ভব বোধি বা বটবৃক্ষ কেন্দ্রিক পূজাস্থল থেকে বটেশ্বর গ্রামটির নামকরণ এবং এই নামকরণে বৌদ্ধ প্রভাব রয়েছে৷ উয়ারী নামকরণটি সংস্কৃত উপকারিকা শব্দ হতে উদ্ভূত৷ উপকারিকা অর্থ রাজবাড়ী বা রাজবাসযোগ্য পটমণ্ডপাদি৷ হিন্দীতে উয়ারী অর্থ পরিখাবেষ্টিত স্থান৷ এখানে অসম রাজার গড় ও পরিখা রয়েছে৷ এই অসম রাজা কি আহোমরাজ নাকি অসমশক্তিধর রাজা? তার প্রকৃত নাম ও সময়কাল সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নি৷ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খাঁ নদীর মিলনস্থলের অদূরে কয়রা নামক একটি শুষ্ক নদীখাতের দক্ষিণতীরে বন্যামুক্ত গৈরিক মাটির উঁচু ভূখণ্ডে উয়ারী-বটেশ্বরের অবস্থান৷ ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় আদি ঐতিহাসিক কালপর্বে এ প্রত্নস্থানকে বহির্বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে অধিকতর সুস্পষ্ট করেছে৷ টলেমির বিবরণ থেকে চক্রবর্তীর অনুমান আদি ঐতিহাসিক যুগে উয়ারী-বটেশ্বর দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের বাণিজ্যিক মালামাল সংগ্রহ ও বিতরণের সওদাগরী আড়ত (Entry port) হিসাবে কাজ করতো৷৪৮ তাঁর এই ধারণাকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন এস এম রহমান৷ তিনি এই প্রত্নক্ষেত্রে অনেক সম্ভাব্য নিদর্শন প্রাপ্তির অপ্রতুলতায় স্থানটিকে 'রহস্যময়' বলেছেন৷৪৯ একমাত্র ব্যাপক উত্খননের মাধ্যমেই স্থানটির রহস্য উন্মোচন সম্ভব৷ উয়ারী-বটেশ্বরের প্রত্ননিদর্শন সম্ভার স্থানটিকে বাংলাদেশের আদি ঐতিহাসিক কালপর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে৷ প্রয়াত মোহাম্মদ হানীফ পাঠান এ সব নিদর্শন সংগ্রহের সূচনা করে অলক্ষ্যে আমার হৃদয়ে যে উত্সাহ বহ্নি জ্বালিয়ে গিয়েছেন তারই ধারাবাহিকতায় প্রায় তিন যুগ ধরে বিনা পারিশ্রমিকের মজুরের মত নিজেকে একাজে ব্যাপৃত রেখেছি৷ ইতিহাস অথবা প্রত্নক্ষেত্রটির স্বরূপ অনুধাবন আমার দিবারাত্রের ধ্যান ও স্বপ্ন৷ ইতিমধ্যে দেশ ও বিদেশের অনেক খ্যাতিমান প্রত্নতত্ত্ববিদ উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে মূল্যবান গবেষণা সন্দর্ভ প্রকাশ করেছেন৷ আশা করছি ভবিষ্যতে এ নিয়ে আরো বিস্তৃত পরিসরে গবেষণা সম্পন্ন হবে_যার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের গৌরবময় পীঠস্থান উয়ারী-বটেশ্বর-এর সামগ্রিক ইতিহাস উন্মোচিত হবে৷