বুধবার, ২৯ এপ্রিল, ২০০৯

সুনামগঞ্জের

সুনামগঞ্জের
নামকরণ: ‘সুনামদি’ নামক জনৈক মোগল সিপাহীর নামানুসারে সুনামগঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল বলে জানা যায়। ‘সুনামদি’ (সুনাম উদ্দিনের আঞ্চলিক রূপ) নামক উক্ত মোগল সৈন্যের কোন এক যুদ্ধে বীরোচিত কৃতিত্বের জন্য সম্রাট কর্তৃক সুনামদিকে এখানে কিছু ভূমি পুরস্কার হিসাবে দান করা হয়। তাঁর দানস্বরূপ প্রাপ্ত ভূমিতে তাঁরই নামে সুনামগঞ্জ বাজারটি স্থাপিত হয়েছিল। এভাবে সুনামগঞ্জ নামের ও স্থানের উৎপত্তি হয়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে। প্রাচীন ইতিহাস: সুনামগঞ্জের ইতিহাস অতি প্রাচীন। অসংখ্য কিংবদন্তী এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও তথ্যাবলীতে সমৃদ্ধ। প্রাচীন ইতিহাস থেকে অনুমান করা হয়, সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র অঞ্চল এককালে আসামের কামরূপ বা প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সুনামগঞ্জের লাউড় পরগনায় এখনো প্রবাদ হিসেবে কথিত আছে লাউড় পাহাড়ের উপরই কামরূপের রাজা ‘ভগদত্তের’ রাজধানী ছিল। এ ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন বলেও কিংবদন্তী রয়েছে। টাংগাইলের মধুপুর বনেও উক্ত রাজারবাড়ীর চিহ্ন ছিল বলে জানা যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এ ভগদত্ত ও মহাভারতের ভগদত্ত ও মহাভারতের ভগদত্ত এক ব্যক্তি নন, বরং কথিত ভগদত্ত মহাভারতের অনেক পরের কালের মানুষ। এটাই সত্য। কারণ কিংবদন্তী ও ইতিহাস যেখানে মিল হবে না সেখানে ইতিহাস ভিত্তি ধরাই বিধেয়। বৃহত্তর সিলেট সূদুর অতীতে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এ রাজ্যগুলো হচ্ছে লাউড়, গৌড় ও জয়ন্তিয়া। অনুমান করা হয়, এ লাউড় রাজ্যের সীমানা বর্তমান সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলা ও ময়মনসিংহ জেলা এবং হবিগঞ্জ জেলার কিয়দংশ নিয়ে গঠিত ছিল। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল লাউড়। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর থানার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের হলহলিয়া নামে পরিচিতি গ্রামে লাউড়ের রাজা বিজয় সিংহের বাসস্থানের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন এখনো বিদ্যমান। স্থানীয়ভাবে এটি হাবেলী (হাওলী) নামে পরিচিতি। লাউড় রাজ্যের নৌঘাটি ছিল দিনারপুর নামক স্থানে। এটি বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। রাজধানী লাউড় থেকে নৌঘাটি পর্যন্ত সারা বছর চলাচল উপযোগী একটি ট্রাংক রোডের অস্তিত্ব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের সমর্থন পাওয়া যায়। সুনামগঞ্জের তদানীন্তন ডেপুটি ইন্সপেক্টর অব স্কুলস জনাব মুহাম্মদ ওয়াসিল উক্ত ট্রাংক রোডের ধ্বংসাবশেষ থেকে এ তথ্য উদঘাটন করেছিলেন। মনে করা হয় লাউড় অধিপতি কর্তৃক এ ট্রাংক রোডটি নৌঘাটিতে সংযোগ স্থাপনের জন্যই নির্মিত হয়েছিল। অনুমান করা হয়, সুনামগঞ্জ জেলার বেশীর ভাগ অঞ্চল এককালে একটি সাগরের বুকে নিমজ্জিত ছিল যা কালে কালে পলি ভরাট জনিত কারণে ও ভূ-প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সূত্র ধরে ভূখন্ডে পরিণত হয়েছে। সুনামগঞ্জের ভূগর্ভে চুনা পাথরের খনি ও কয়লা আবিস্কারের ফলে এরূপ চিন্তার সক্রিয় সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া এখানকার শত শত হাওরের গঠন প্রকৃতি (basis type) বিশ্লেষণ করেও এ মতের সমর্থন দৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সুনামগঞ্জের টেকেরঘাট প্রাপ্ত চুনাপাথর এক ধরণের ক্যালসিয়াম যা সামুদ্রিক প্রাচীন শামুক ও শৈবাল দ্বারা সৃষ্ট। এতেও পূর্বোক্ত ধারণার পেছনে বৈজ্ঞানিক যোগ সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। প্রায় সব ঐতিহাসিক সূত্র মতে, সুনামগঞ্জের বিশাল ভূখন্ড যে সাগর বক্ষ থেকে জেগে উঠেছে সে সাগরকে ‘কালিদহ’ সাগর বলে চিহ্নি করা হয়েছে। এ কালিদহ সাগর সুনামগঞ্জ জেলার সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল। হাছন রাজার জ্যেষ্ঠ পুত্র খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা চৌধুরীর আত্মজীবনীমূলক রোজনামচাতেও এর উল্লেখ রয়েছে; রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক গান, পালা-পার্বণের অনুষ্ঠানগুলিতেও। সিলেটের কালেক্টর মিঃ লিন্ডসের অষ্টাদশ শতাব্দীতে লিখিত বর্ণনা থেকেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- “In the pre Historic days the southern part of Sadar Subdivision and the northern part of Moulivibazar and Habiganj Subdivision and nearly the entire Sunamganj Subdivision were a part of Bay of Bengal.” হাওর শব্দটি সায়র (সাগর) থেকে এসছে। বর্ষাকালে সুনামগঞ্জের হাওরগুলো এখনো সে রূপই ধারণ করে। সুদূর অতীতে এই কালিদহ সাগর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যার উপর দিয়ে ১০১১ খ্রিষ্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েন সাং জাহাজে করে সরাসরি তাম্রলিপ্ত থেকে সিলেট পৌঁছেছিলেন বলে তাঁর লেখা থেকে জানা যায়। তাঁর মতে, নহরী আজরক নামে একটি নদী কামরূপের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে হাবাং শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ নদী দিয়ে বাংলা ও গৌড়ে যাওয়া যেত। এ নদীকে প্রাচীন সুরমা বলে ঐতিহাসিকরামনে করে থাকেন। প্রাচীন লাউড় একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। ঐতিহাসিক ডব্লিউ.ডব্লিউ.হান্টারের মতে, ‘‘মোগল অধিকারের পর (সম্ভবত ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে) লাউড় প্রথম বারের মততার স্বাধীনতা হারায় এবং মোগলদের করতলগত হয়’’, লাউড় রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কেশব মিশ্র নামক জনৈক ব্যক্তি। এঁরা ছিলেন কাত্যান গৌত্রীয় মিশ্র। তাঁদের উপাধি ছিল সিংহ। এ রাজাদের জগন্নাথপুর ও বানিয়াচুংগে আরো দুটি উপ-রাজধানী ছিল। লাউড়ে পঞ্চদশ শতাব্দীতে দিব্য সিংহ নামে জনৈক রাজা রাজত্ব করতেন। কথিথ আছে বিখ্যাত বৈষ্ণব সাধক অদ্বৈতাচার্যের পিতা কুবের আচার্য, রাজা দিব্য সিংহের মন্ত্রী ছিলেন। এ কুবের আচার্যের পিতা নরসিংহ, নাড়িয়াল রাজা গণেশের মন্ত্রী ছিলেন। লাউড়ের রাজা দিব্যসিংহ বৃদ্ধ বয়সে রাভ্যভার তদীয় পুত্রের হাতে ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন এবং তদীয় মন্ত্রীপুত্র অদ্বৈতাচার্যের (জন্ম ১৪৩৫ খ্রিঃ) শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই অদ্বৈতাচার্যই বৈষ্ণব সাহিত্যের অদ্বৈত মহাপ্রভু নামে খ্যাত এবং দিব্যসিংহ লাউড়ীয়া কৃষ্ণদাশ নামে পরিচিত। কথিত আছে, অদ্বৈত মহাপ্রভুর মাতা লাভাদেবী তার জীবদ্দশায় গঙ্গায় গিয়ে গঙ্গাস্নান করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁকে বৃদ্ধাবস্থায় এতদূর নিয়ে গঙ্গাস্নান করানো সম্ভবপর ছিল না। এ কারণে অদ্বৈত মহাপ্রভু তার মাতৃবাক্য পালনের পুণ্য উদ্দেশ্যে যোগ সাধনা বলে পৃথিবীর সমস্ত তীর্থের জল রেনুকা (তাহিরপুর থানার বর্তমানে যাদুকাটা নদীর প্রাচীন নাম) নদীর জলের ধারায় একত্রিত করে প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন। তাঁর সাধনা সিদ্ধ ফলকে বারুনীযোগ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। এ কারণে প্রতি বছর চৈত্র মাসের নির্দিষ্ট দিনে এ স্থানে বারুনী মেলা হয়। এ উপলক্ষে উক্ত নদীতে হাজার হাজার হিন্দু পুর্ণার্থীদের পুণ্য স্থান অনুষ্ঠিত হয়। এ অবগাহনে তাদের মনস্কাম পূর্ণ হয় বলে তাদের বিশ্বাস। ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে মোবারকদ্দৌলা নামে লাউড়ের রাজার একজন উজির ছিলেন বলে সৈয়দ মর্তুজা আলী সাহেব উল্লেখ করেছেন। সোনাগাঁয়ে প্রাপ্ত ১৪৭৪ সালের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, মোবারকদৌল্লা মালিক উদ্দিন নামক মোয়াজ্জমাবাদ ও লাউড়ের উজির একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মোগল আমলঃ মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) লাউড়ের রাজা গোবিন্দ সিংহ তার জ্ঞাতি জগন্নাথপুরের রাজা বিজয়সিংহের সাথে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিলেন। রাজা বিজয় সিংহ গুপ্ত ঘাতকের হাতে নিহত হলে তাঁর বংশধরগণ এ হত্যার জন্য গোবিন্দ সিংহকে দায়ী করে তার বিরুদ্ধে মোগল রাজ দরবারে নালিশ করে বিচার প্রার্থনা করেন। এজন্য সম্রাট আকবর দিল্লী থেকে সৈন্য পাঠিয়ে গোবিন্দ সিংহকে দিল্লীতে ডেকে আনেন। বিচারে গোবিন্দ সিংহের ফাঁসির হুকুম হয়। গোবিন্দ সিংহের অপর নাম ছিল জয়সিংহ। সমসাময়িক সময়ে জংসিংহ নামে অপর এক ব্যক্তি রাজা গোবিন্দ সিংহের সম্রাট আকবরের কারাগারে আটক ছিল। প্রহরীরা ভুলবশতঃ রাজা গোবিন্দ সিংহের পরিবর্তে ঐ জয়সিংহকে জল্লাদের হাতে তুলে দেয়। ফলে নির্দিষ্ট দিনে গোবিন্দ সিংহের পরিবর্তে ঐ জয়সিংহ নামক ব্যক্তিটি ফাঁসিতে প্রাণ হারান। গোবিন্দ সিংহের প্রাণ এভাবে দৈবাৎ রক্ষা পাওয়ায় তিনি সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি সম্রাট আকবরের নিকট প্রাণ ভিক্ষা চান ও ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। সম্রাট তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। গোবিন্দ সিংহের নামকরণ করা হয় হাবিব খাঁ। সম্রাট আকবর গোবিন্দ সিংহ (হাবিব খাঁ) কে তার হৃত রাজ্য পুনরায় দান করেন। সাব্যস্ত হয় হাবিব খাঁ সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করবেন এবং এর জন্য সম্রাটের জমার পরিবর্তে ৬৮ খানা কোষা নৌকা নির্মাণ করে তিনি সম্রাটকে সরবরাহ করবেন । এ নৌকা খাসিয়াদের আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষার জন্য মোগল ও স্থানীয় বাহিনী কর্তৃক নৌপথে রণতরী হিসেবে ব্যবহার করা হবে। মুক্তির পর হাবিব খাঁ মোগল সৈন্যসহ দেশে ফিরে আসেন। তার দুর্বলতার কথা খাসিয়াদের বুঝতে বাকী ছিল না। এ কারণে খাসিয়াদের উৎপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি লাউড় ছেড়ে বানিয়াচুংগে গিয়ে সপরিবারে বসবাস করতে শুরু করেন। লাউড়ের রাজবংশ পূর্বেই নির্বংশ হয়ে গিয়েছিল। হাবিব খাঁর বংশধররা লাউড় ও বানিয়াচুংগ উভয় স্থানে বিভক্ত হয়ে বসবাস করতেন। ১৭৪৪ খ্রিষ্টাব্দে খাসিয়াদের আক্রমণে লাউড় রাজধানী সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে গেলে লাউড় রাজার বংশধররা বানিয়াচুংগে চলে যান। পরে হাবিব খাঁর অধঃস্তন পুরুষ জনৈক উমেদ রাজা লাউড়ে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এ দূর্গের ধ্বংসাবশেষই লাউড়ের হাবেলী নামে পরিচিত। পরে বানিয়াচুংগ পর্যন্ত এ আক্রমন সম্প্রসারিত হওয়ার আশঙ্কায় উমেদ রাজা বানিয়াচুঙ্গ রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন এবং বানিয়াচুঙ্গের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে তা সুরক্ষিত করেন। এ পরিখার ধ্বংসাবশেষ আজও বানিয়াচুংগে বিদ্যমান আছে। প্রাচীনকালে আরো কিছু কথাঃ হট্টনাথের পাঁচালীতে আছে কামরূপ রাজ কামসিন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁর রাণী উর্মি, প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা কর্তৃক বিতাড়িত হন। পরে রাণী উর্মি জৈন্তা পাহাড়ের সংলগ্ন নারী রাজ্যের কিছু অংশ নিয়ে একটি রাজ্যের পত্তন করেন। রানী উর্মির কন্যা ছিল উর্বরা। তিববত দেশের হাটক নগরের যুবরাজ ‘কৃষক’ নারী রাজ্য ভ্রমণ করতে আসেন। রাজকুমার ‘কৃষক’ রাজকন্যা উর্বরার প্রেমে পতিত হন ও তাকে বিয়ে করেন। তাদের ঔরষে এক পুত্রের জন্ম হয় যার নাম রাখা হয় হাটক। হাটক তার মাতামহীর সিংহাসনে বসেন । হাটকের একপুত্র হয় তার নাম গুহক। রাজা গুহকের তিন পুত্র দুই কন্যা। পুত্রদের নাম লড্ডুক, গুড়ক ও জয়ন্তক। গুহকের মৃত্যুর পর তার রাজ্য তিন পুত্রের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। অংশের নাম হয় জয়ন্তিয়া। লাউড় রাজ লড্ডুকের মৃত্যুর পর তৎপুত্র শম্ভুক রাজা হন। তারপর তার বংশীয় আদিত্য. দেবদত্ত, ভগদত্ত, নবার্জুন, মাধব ও প্রমর্দন পরপর লাউড় অধিপতি হন। প্রমর্দন রাজা সম্ভভ দ্বাদশ শতকে রাজস্ব করতেন। তিনি গৌড় রাজ, ক্ষেত্র পালের সমসাময়িক ছিলেন। এই প্রমর্দনই কৃষক বংশীয় শেষ রাজা। তারপর আচার্য বংশী অরুণাচার্য, লাউড়ের সিংহাসনে বসেন। তৎপর রাজা হন বিজয় মানিক্য। রাজা বিজয় মানিক্যের আমলে একটি মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। মুদ্রার উপর বাংলায় লেখা আছে ‘‘রাজা বিজয় মানিক্য শ্রী শ্রী লক্ষ্মী দেব্য শক ১১১৩’’। এতে প্রমাণিত হয় যে, ১১৯১ খ্রিষ্টাব্দে রাজা বিজয় মানিজ্য রাজস্ব করতেন। পুরাতত্ত্ববিদদের মতে, এ মুদ্রা ত্রিপুরার রাজা বিজয় মানিক্যের (১৫৪০-৭১) । তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণ। জগন্নাথ নামক জনৈক বিপ্র বিজয় মানিক্যের আশ্রয়ে এক বাসুদেব বিগ্রহ স্থাপন করেন। দ্বিজভক্ত বিজয় মানিক্যদেবের সেবার জন্য জগন্নাথ বিপ্রকে কিছু ভূমি দান করেন। জগন্নাথ বিপ্রের নামানুসারে সেই ভূমিই জগন্নাথপুর নাম প্রাপ্ত হয়। বিজয় মানিক্যের দুই মহিষী ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল লক্ষ্মী ও শ্রী। উক্ত মহিষীদের নামে তিনি বাসুদেব মন্দিরের পিছনে দুইটি পুস্করিনী খনন করেন। জগন্নাথপুরের ক্যাতায়ন গোত্রীয় ব্রাহ্মণগণ নিজেদেরকে লাউড়ের রাজার বংশধর বলে পরিচয় দেন। দিব্য সিংহো পুত্রের পর রামানাথ নামক এক ব্যক্তি লাউড়ের রাজা হন। তার ছিল তিন পুত্র। প্রথম পুত্র কাশিবাসী হন। দ্বিতীয় পুত্র লাউড়ের সিংহাসনে বসেন এবং তৃতীয় পুত্র কেশব জগন্নাথপুরে এসে বসবাস করেন। এই কেশবই জগন্নাথপুর রাজবংশের আদিপুরুষ। কেশবের এক পুত্র ছিল শনি বা সনাই। তার পুত্র প্রজাপতি। প্রজাপতির পুত্র হলেন দুর্বার খাঁ। দুর্বার খাঁ পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। জগন্নাথপুরের বিরাট দীঘিটি তারই কীর্তি। দুর্বার সিংহ এই দীঘি খনন করে সম্রাট আকবর থেকে খাঁ উপাধি প্রাপ্ত হন। দুর্বার খাঁর পুত্র রাজ সিংহ। রাজসিংহের তিন পুত্র জয় সিংহ, বিজয় সিংহ ও পরমানন্দ সিংহ। এই সময় লাউড়ের রাজা মারা যান। লাউড় রাজ্য কুমারদের প্রাপ্য ছিল। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। সম্ভবত এ কারণেই সম্রাট আকবরের আমলে পূর্বোক্ত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। অন্য তথ্য সূত্রে জানা যায়, সুনামগঞ্জে আরেকটি সামন্ত রাজ্য ছিল। ঐ রাজ্যের নাম ছিল মগধ। মগধ রাজ্যের রাজপুত্র রাজ্য হারা হয়ে ঐ এলাকায় আগমন করেন। খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে মগধ নামে একটি পাহাড় আছে। এই পাহাড়ের পাদদেশে চম্পাগাছের বাগানে এক সুন্দর পরিবেশে ঐ রাজপুত্রকে খাসিয়ারা তাদের রাজা হিসেবে বরণ করে নেয়। চম্পাতলায় সে অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে রাজধানীর নামকরণ হয় চম্পাতলা। এই চম্পাতলা স্থানীয়ভাবে ‘চামতলা’ নামে পরিচিত। এই রাজ্যে ধুনরাজা নামক জনৈক রাজা খুব প্রভাবশালী রাজা ছিলেন। তিনি রণবিদ্যায় খুব পারদর্শী ছিলেন। তিনি জগন্নাথপুরের রাজকন্যা ও দোহালিয়ার জনৈক জমিদার কন্যাকে বিবাব করেন। ইংরেজ আমলঃ ১৫৫৭ সালের ২৩শে জুন বাংলার স্বাধীনতা সূর্য পলাশীর আম্রকানে অস্তমিত হলে পাক-ভারত উপমহাদেশের শাসনাভার ইংরেজ বেনিয়া ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়। স্বাভাবিকভাবে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের সাথে বৃহত্তর সিলেট জেলাও কোম্পানীর শাসনাধীনে চলে যায়। ১৭৬৫ সালে বৃহত্তর সিলেটের রাজস্ব আদায়ের ভার কোম্পানীর হাতে ন্যস্ত হয়। কোম্পানী দেশের শাসনাভার গ্রহণ করে তাদের শাসনের সুবিধার্থে স্থানীয় কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন সাধন করে। আপাতদৃষ্টিতে এগুলোকে সংস্কারমুখী মনে করা হলেও মূলত এগুলো ছিল তাদের সূক্ষ্ম চালের আরেকটি অংশ। এতে করে দেশীয় কাঠামোতে অভ্যস্ত জনগণকে নতুন কাঠামোতে ফেলে স্বীয় স্বার্থ সিদ্ধিতে লাগানো শুরু হয়। উপরন্তু ইংরেজরা প্রতিটি কাঠামোতে নিজেদের লোক বসানো শুরু করে। বৃহত্তর সিলেটে প্রথম ধাক্কা আসে এটিকে আসাম প্রদেশের সাথে অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে । ১৮৭৪ সালের ১২ ই সেপ্টেম্বর তারিখের এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে আসাম প্রদেশ গঠন করা হলে সিলেটকে প্রথম বারের মত আসাম প্রদেশের অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত সিলেট বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ ও ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ছিল। সিলেটকে আসাম প্রদেশের সাথে সংযুক্তির বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে ব্যাপক আপত্তি উঠলে ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক সিলেট আসনে ও প্রতিশ্রুতি দেন যে, সিলেটকে আসামের অন্তর্ভূক্ত করা হলেও এর বিধি ব্যবস্থা আগের মতই অপরিবর্তিত থাকবে এবং এ অঞ্চলের শিক্ষা ও বিচার ব্যবস্থা কার্যক্রম কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও কোলকাতা হাইকোর্টের অধীনে পূর্ববৎ চালু রাখা হবে। এরপর বৃহত্তর সিলেট জেলার রাজস্ব আয়কে আরো বহুগুণ বাড়ানোর প্রয়োজনে মহকুমা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। উক্ত পরিকল্পনার আওতায় বৃহত্তর সিলেট জেলার প্রথম মহকুমায় স্থাপিত হয় সুনামগঞ্জে ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে। মিস্টার ব্লেক (Blake) সুনামগঞ্জের প্রথম মহকুমা প্রশাসক (এস,ডি,ও) নিযুক্ত হন। সাবডিভিশনাল অফিসারের বাসভবন ও কাচারী নির্মাণের জন্য কোম্পানী মাত্র ২ হাজার টাকা মঞ্জুর করেন। ১৭৮৯ সালে দশসনা বন্দোবস্তের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে ভূমি মালিকানার মধ্যস্বত্ব হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু করেন। ১৭৯৩ সালে যা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রূপ লাভ করে। উক্ত ব্যবস্থাপনার আওতায় সিলেটের রেসিডেন্ট (কোম্পানীর প্রতিনিধি) মিঃ জন উইলিস বৃহত্তর সিলেটের জন্য ৩,১৬,৯১১/- টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণক্রমে সদর জমা (রাজস্ব) আদায়ের জন্য সমগ্র সিলেট জেলাকে দশটি ভাগে বিভক্ত করেন। এ সমস্ত বিভাগকে জিল্লা বা জেলা বলা হত। সুনামগঞ্জের জেলা সদর ছিল রসুলগঞ্জে (বর্তমান জগন্নাথপুর থানার একটি সমৃদ্ধ বাজার)। এছাড়া সুনামগঞ্জ ও রসুলগঞ্জে একদা দু’টি মুন্সেফ কোর্ট ছিল। অনুমান করা হয় কোর্টগুলো মোগল আমলে স্থাপিত ছিল। যা ইংরেজরা বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আদেশ হলে সিলেট পুনরায় বাংলার অন্তর্ভূক্ত হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে সিলেট পুনরায় আসামে চলে যায়। ১৯৪৭ সলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম না হওয়া পর্যন্ত সিলেট আসামের অন্তর্ভূক্ত ছিল।