মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০০৯



গহীন অরণ্যে নিজেকে আড়াল রাখতে ভালোবাসে খাসিয়ারা
গহীন অরণ্যে নিজেকে আড়াল রাখতে ভালোবাসে খাসিয়ারা। আর তাইতো সাধারন মানুষের সাথে তাদের নেই তেমন
যোগাযোগ। তাদের রয়েছে আলাদা গ্রাম। গ্রামকে বলা হয় পুঞ্জি। পাহাড়ি অঞ্চলের উচুঁ টিলাতে পাশাপাশি ঘর করে তাদের বসবাস। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরী করেন। তবে তাদের ঘর মাটি থেকে অনেক উচুঁতে থাকে। সিড়ি বেয়ে উঠতে হয় ঘরে। পাহাড়ি এলাকায় জীবজন্তুর ভয়ে প্রাণ রক্ষার জন্যই এ ধরনের ঘর তারা তৈরী করেন। নিরাপত্তার জন্য তারা সবসময় হাতের কাছে রাখেন তীর, ধনুক ও বন্দুক। খাসিয়ারা নিজেদের অদিবাসী মনে করেন। প্রতিটি পান পুঞ্জিতে বাস করেন ৩০-৪০ থেকে ৮০-৯০ পরিবার। পুঞ্জির প্রধান নির্বাহী হিসাবে একজন গোত্র প্রধান থাকেন। তিনি একটি পুঞ্জির সামাজিক ও ব্যবসায়িক সহ সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক। তারা নিজেদের সমস্যা নিজেদের মধ্যেই মীমাংসা করে থাকেন। খাসিয়া সমপ্রাদায়ের প্রায় ৯০ ভাগই খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী। সিলেটের জাফলং খাসিয়া উপজাতীয়দের আবাস ভূমি। বর্তমানে সিলেটের জৈনপুর, জাফলং, তামাবিল, সুনামগঞ্জ জেলার খাসিয়া জৈন পর্বতমালার সীমান্তবর্তী অঞ্চল, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, কুলাউড়া, ও বড়লেখায় খাসিয়াদের বসবাস। জনশ্রুতি রয়েছে, বৃটিশ আমলের শেষের দিকে খাসিয়া সমপ্রদায়ের কিছু লোক ভারতের শিলং প্রদেশ থেকে জীবিকার সন্ধানে জাফলং এ এসে বসতি স্থাপন করে। পান চাষের সুবিধার্থে তারা বসবাসের স্থান হিসাবে পাহাড়ি অঞ্চলকে বেছে নেয়। সিলেট বিভাগে বর্তমানে ৭৫টি খাসিয়া পুঞ্জি রয়েছে। খাসিয়া সমপ্রদায়ের লোকজন খুবই শানি-প্রিয়, স্বাধীনচেতা, আমুদে, মিতব্যয়ী ও কঠোর পরিশ্রমী। তাদের গায়ের রঙ ফর্সা। নাক চেপটা ও ছোট ছোট। পায়ের গোড়ালি মোটা। দেহের গঠন মাঝারী ও বলিষ্ট। কর্মক্ষেত্রে ও সংসার জীবনে নারী-পুরুষ সমানে-সমান। তবে তাদের সমাজে নারীর স্থান খুবই মর্যাদাপুর্ণ। সংসারের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব নারীদের হাতে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের সহায় সম্পত্তির উত্তরাধিকারীর ক্ষেত্রে কন্যা সন্তানের প্রাপ্যতার রীতি সামাজিক ভাবে প্রচলিত। এই সমপ্রদায়ে একান্নবর্তী বা একক উভয় ধরনের পরিবার ব্যবস্থা বিদ্যমান। ছেলে মেয়েদের সবাই অল্প বয়স থেকেই মা-বাবাকে কর্মক্ষেত্রে সাহায্যের মাধ্যমে কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস- হয়ে পড়ে। বিযের ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়েদের পরস্পরকে পছন্দ করার স্বাধীনতা ও সুযোগ থাকে। অধিকাংশ বিয়ে সম্পন্ন হয় পারস্পরিক পছন্দে। খাসিয়া মেয়েরা সাধারনত তাদের নিজস্ব প্রচলিত পোশাক ব্লাউজ ও লম্বা আর্ট এবং এর সাথে শাড়ির মতো কাঁধের একপাশে থেকে আড়া আড়িভাবে বাধাঁ গোড়ালি পর্যন্ত লুঙ্গির ন্যায় এক প্রস্থ কাপড় পরে থাকেন। পায়ের পাতা, হাত ও মুখমন্ডল ছাড়া পুরো শরীর কাপড়ে ঢেকে যায়। বিভিন্ন উৎসব বা বিশেষ দিনে খাসিয়া ভাষায় ‘ধাবা’ নামে বিশেষ এক ধরনের পোশাক পরেন। এটি একই রঙের বা স্টাইপের ব্লাউজ এবং এক প্রস্থ কাপড় আড়াআড়ি ভাবে উভয় দিকের কাঁধ থেকে গোড়ালি পর্যন- পরিধান করা হয় । পাথর খচিত স্বর্ণের লম্বা দুল, গলার হার ও চুড়ি মেয়েদের প্রিয় অলংকার। টিকলি, নথবিছা বা এ ধরনের অলংকার তারা ব্যবহার করেন না। পুরুষরা সাধারনত প্যান্ট-শার্ট, কোট ও জ্যাকেট পরে থাকেন।খাসিয়াদের রয়েছে নিজেদের ভাষায় রয়েছে নিজস্ব সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি। খাসিয়ারা মাছ-ভাত মাংস সবই খাদ্য হিসাবে গ্রহন করেন। তাদের সমপ্রদায়ে প্রায় ৯৮ শতাংশ অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। তবে উচ্চ শিক্ষার হার খুবই কম। খাসিয়াদের গ্রাম বা পুঞ্জি প্রতিষ্টিত হয় ব্যক্তিমালিকানা অথবা খতিয়ানভুক্ত পাহাড়ী ভূমি বন্দোবস- নেয়ার মাধ্যমে। প্রাচীনকালে পান-সুপারী, কমলা, নাশপাতি প্রভৃতি ফলমুল ও বিভিন্ন জাতের শাক-সবজি চাষ করে খাসিয়ারা জীবিকা নির্বাহের প্রধান বহন। তবে বর্তমানে পান চাষই তাদের জীবিকা নির্বাহের প্রধান অবলম্বন। দেশের উৎপাদিত পানের সিংহ ভাগই পান উৎপাদিত হয় বৃহত্তর সিলেটের পাহাড়ী অঞ্চলে। খাসিয়ারা যে পান চাষ করেন সেটিও খাসিয়া প্রস্থ নামে খ্যাত। এই পান চাষের ধরন দেশের অন্যান্য পান চাষের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। খাসিয়া পান প্রাকৃতির গাছকে অবলম্বন করে উৎপন্ন হয়। পাহাড়ী অঞ্চল ও বৃষ্টিবহুল উচু স্থানে গাছের ছায়া সমৃদ্ধ ঠান্ডা মাটিতে এই পান উৎপন্ন হয়। কোনও ধরনের সার প্রয়োগের প্রয়োজন পড়েনা । পানগাছ পোকা মাকড় আক্রান- হলেও কীটনাশক ব্যবহার সামাজিক ভাবে নিষিদ্ধ । গাছের পাতা,মরা ডাল-পালা পান গাছের গোড়ায় সার হিসাবে ব্যবহার করা হয়। উচু গাছ থেকে মই দিয়ে পান সংগ্রহ করা হয। এরপর মহিলারা গুছি বা গুনে সাজিয়ে খাচা ভর্তি করে কলাপতা ছানি দিয়ে বেধে রাখেন বাজারজাত করণের জন্য। খাসিয়াদের উৎপাদিত পান বৃহত্তর সিলেটের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী হয় লন্ডন আমেরিকায়। এই পান থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হলেও ভাল নেই খাসিয়া সমপ্রদায়। সমস্যা তাদের পদে পদে। শহর সভ্যতা থেকে দুরের জনপদে তাদের নেই যোগাযোগের ভাল ব্যবস্থা। কাঁচা-ভাঙা মেঠো সড়ক। নেই কোন ডাক্তার কিংবা চিকিৎসাসেবা। তারা পাচ্ছেন না সরকারের পক্ষ থেকে নুন্যতম চিকিৎসা সুবিধা। তারপরও তারা বংশানুক্রমে টিকে আছেন এ পেশায়। এভাবেই চলছে খাসিয়া