সোমবার, ২৭ এপ্রিল, ২০০৯

MD.JOYNUL HAQUE

পৃথিম পাশার নবাব আলী আমজাদের ঘড়িপৃথিম পাশার জমিদার নবাব আলী আমজাদের ঘড়ি/ জিতু মিয়ার গাড়ি ও বঙ্কু মিয়ার দাড়িসিলেট নগরীর প্রবেশদ্বার সুরমা নদী। স্রোতস্বিনী সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে সিলেট মহানগরীর ঐতিহ্যবাহী কিন ব্রিজের ডান পাশে নবাব আলী আমজাদের ঘড়িটি অবস্থিত। ঘড়ির ডায়ামিটার আড়াই ফুট এবং ঘড়ির কাঁটা দুই ফুট লম্বা। এ অঞ্চলে যখন ঘড়ির অবাধ প্রচলন ছিল না, মানুষ সূর্যের দিকে তাকিয়ে সময় আন্দাজ করতেন, ঠিক সে সময় অর্থাৎ ১৩৩ বছর আগে ১৮৭৪ সালে সিলেট মহানগরীর প্রবেশদ্বার (উত্তর সুরমা) কিন ব্রিজের ডান পাশে সুরমা নদীর তীরে এই ঐতিহাসিক ঘড়িঘরটি নির্মাণ করেন সিলেটের কুলাউড়ার পৃথিম পাশার নামজাদা জমিদার নবাব আলী আমজাদ খান। লোহার খুঁটির ওপর ঢেউটিন দিয়ে সুউচ্চ গম্বুজ আকৃতির এ মনোরম স্থাপত্য শৈলীর পরিচায়ক ঘড়িঘরটি তখন থেকেই আলী আমজাদের ঘড়িঘর নামে পরিচিতি লাভ করে।আসামের গভর্নর লর্ড নর্থ ব্রুকের সিলেট শুভাগমন উপলক্ষে তার সম্মানে এই ঘড়িঘরটি কলকাতার নামজাদা কারিগর দ্বারা নির্মাণের পাশাপাশি ঘড়িঘরের সম্মুখে সুরমা নদীর চাঁদনী ঘাটে দীর্ঘ ২৮ পাটির সিঁড়িও নির্মাণ করা হয়। জাহাজে গভর্নর নর্থ ব্রুক সিলেট পৌঁছার পর সিঁড়ি ভেঙে নদীতীরে ওঠার সুবিধার জন্য এই সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়েছিল। তখনকার সময় সিলেটে এ দুটি বিখ্যাত জিনিস ছাড়াও দর্শনীয় ছিল জিতু মিয়ার গাড়ি।মুক্তিযুদ্ধের আগে পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘড়িঘরটি সচল ছিল। সে সময় এ সুবিশাল ঘড়িটির মেশিন চাবি দিয়ে চালানো হতো। প্রতিদিন ঘড়ির চাবি দেয়ার জন্য তৎকালীন পৌরসভায় একজন কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। বিরাট আকারের ডায়াল ও কাঁটা সংযুক্ত সুবিশাল ঘড়িটির ঘণ্টাধ্বনি শহরের বাইরে অনেকদূর থেকেও শোনা যেত। নির্মাণের পর এই আকর্ষণীয় ঘড়িটি দেখার জন্য প্রতিদিন সিলেটের দূর-দূরান্তের গ্রামাঞ্চল থেকে লোকজনের শহরে আগমন ঘটত। সে আমলে মানুষজন শহরের প্রবেশপথে স্থাপিত ঘড়িঘরের সময় দেখে শহরে আসা-যাওয়া ও কাজকর্ম সম্পাদন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে এই প্রাচীন ঘড়িঘর বিধ্বস্ত হয়। স্বাধীনতার পর পৌরসভা মেরামতের মাধ্যমে ঘড়িটি সচল করলেও কিছুদিনের মধ্যে ঘড়ির কাঁটা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৭ সালে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান আ ফ ম কামাল অ্যাডভোকেটের আন্তরিক প্রচেষ্টায় নবাব আলী আমজাদের ঘড়ি মেরামত করে আবার চালু করা হয়। এ সময় ঘড়িটি চালু করার জন্য ঢাকার একটি কোম্পানির কারিগররা ঘড়িটি চালু রাখার জন্য রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে ঘড়িটি সচল রাখার ব্যবস্থা নেয়। পৌর চেয়ারম্যানের অফিস কক্ষ থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ঘড়ির কাঁটা ঘুরত। কিন্তু দু'চার বছর যেতে না যেতেই ঘড়ির কাঁটা আবার বন্ধ হয়ে যায়। সিলেট নগরীর ঐতিহ্যের স্মারক নবাব আলী আমজাদের ঘড়ি দীর্ঘদিন ধরে অচল অবস্থায় পড়ে থেকে পরগাছা ও কবুতরের বাসায় পরিণত হয়। বছরখানেক আগে সিলেটের ঐতিহাসিক নিদর্শন রক্ষায় নবাব আলী আমজাদের ঘড়ি চালু করতে জেলা পরিষদ এগিয়ে আসে। দেরিতে হলেও ঘড়িটি সচল করার উদ্যোগ নেয়াকে সবাই সাধুবাদ জানায়। এবার জাপানি সিজান কোম্পানি ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে ঘড়িটি আবার চালু করে। চারপাশে বেষ্টনীর ওপর তিন ফুট উঁচু গ্রিল তৈরি করে ঘড়িটিকে সুরক্ষিত করা হয়। কিন্তু বছর না ঘুরতেই ঘড়িটির কাঁটা আবারও বন্ধ হয়ে যায়। এখন আর ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে না। দীর্ঘদিন থেকে মহানগরীর অন্যতম আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক কীর্তি নবাব আলী আমজাদের ঘড়িঘর অযত্ন-অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অচল হয়ে পড়ে আছে। নগরবাসীর অভিযোগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন না থাকায় এই ঐতিহাসিক দর্শনীয় ঘড়িটি ভগ্নদশায় নিপতিত। ঐতিহাসিক নবাব আলী আমজাদের ঘড়ি পর্যটকদের জন্য এক অন্যতম আকর্ষণ। নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনে এই ঘড়ির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সিলেট বেড়াতে এসে ঘড়িঘর দেখতে কেউ ভুল করেন না। সুরমা নদীর তীরবর্তী ঘড়িঘর ও এর লাগোয়া ঐতিহাসিক কিন ব্রিজ ও চাঁদনীঘাট এলাকাটি সিলেট মহানগরের একটি আকর্ষণীয় স্থান। এর পার্শ্ববর্তী সুরমা নদীর পাড় বাঁধাই করে রেলিং দিয়েও অত্যাধুনিক ফোয়ারা স্থাপন করে এলাকাটি একটি বিনোদনের স্পট তৈরি হয়েছে। প্রতিদিন দেশী-বিদেশী পর্যটক ও নগরবাসী এখানে বেড়াতে, অবসর সময় কাটাতে এবং চিত্তবিনোদনের জন্য আসেন।