সিলেটে
সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস
সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীনকালে সিলেট বিভিন্ন খন্ডরাজ্যে বিভক্ত ছিল। বাংলাদেশের বিশাল অংশ যখন সাগরের গর্ভে বিলীন, সিলেট তখন ও ছিল সভ্য সমাজ। সিলেটের ভাটি এলাকা এক সময় ছিল সমুদ্র। কিন্তু উচুঁ ও পার্বত্য এলাকায় ছিল জনবসতি। ঠিক কোন সময়ে জনবসতির সূচনা হয় তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। ঐতিহাসিক যুগ শুরু হয়েছে খৃষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার অব্দে। ইতিহাস বিজ্ঞানীরা ঐতিহাসিক যুগকে প্রাচীন মধ্য ও আধুনিক যুগে ভাগ করেছেন। ইতিহাসের প্রাচীন যুগ থেকে সিলেট জনবসতি শুরুর হদিস পাওয়া যায়। প্রাচীন যুগের ইতিহাসের অবলম্বন প্রায় সর্বত্রই পৌরাণিক গ্রন্থাদি, কিংবদন্তী, তন্দ্রমন্ত্র শিলালিপি প্রভৃতি। এসব উৎস হতে দেখা যায় খৃষ্টপূর্ব চার হাজার অব্দে ও সিলেটে উন্নত সমাজ ছিল। প্রাচীনকালেও সিলেট বিভিন্ন খন্ডরাজ্যে চিহ্নিত ছিল। এর আয়তন ও সীমা বারবার বদল হয়েছে। সিলেট অভিহিত হয়েছে বিভিন্ন নামে।
মহাভারতের যুগে জৈন্তাকে নারী রাজ্য বলা হতো। ‘জৈমিনি ভারত’ গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী ‘প্রমীলা’ ছিলেন ঐ রাজ্যের রানী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বিজয়ী যুধিষ্ঠিবের, যজ্ঞের অশ্ব প্রমীলা আটক করেন। মহাবীর অর্জুন চারজন যুদ্ধাসহ ছুটে আসেন জৈন্তায়। রমণীর সাথে যুদ্ধে কৃতিত্ব নেই ভেবে অর্জুন রানীর সঙ্গে আপোষ করে তাঁকে বিবাহ করেন এবং অশ্ব মুক্ত করে নিয়ে যান।
কিরাত রাজ্য নামে একটি রাজ্যের কথা জানা যায় বিষ্ণুপুরাণে। কিরাত ভূমিতে সিলেটের হরিপুরের তপ্তকুন্ড প্রস্রবন ও গুরুর পুরাণে কিরাত দেশের মনু নদীর উল্লেখ এবং ম্যাকক্রিন্ডেল সাহেবের কিরাতিয়া রাজ্যের বর্ণনা থেকে অনেকে মনে করেন এক সময় হরিপুর থেকে মনুতীরবর্তী জনপদ কিরাত রাজ্যভুক্ত ছিল।
হিন্দু শাস্ত্রের গ্রন্থসমূহে সিলেটের নদ নদীর নাম পাওয়া যায়। রাজমালার বর্ণনায় জানা যায় আদিযুগে মনু যে নদীর তীরে বসে শিবপূজা করতেন সেটিই মনু নদী নামে পরিচিত হয়। অমরশেষ অভিধানে বর্ণিত ‘শরাবতী’-কে কেউ কেউ সুরমা মনে করেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এ সব নদীর জল পবিত্র। রামায়নের যুগেও অঞ্চল পবিত্রভূমি রূপে পরিচিত ছিল। আর্যরা বাংলার বিরাট এলাকাকে অপবিত্র জ্ঞান করলেও সিলেট ছিল এর ব্যতিক্রম। কারণ উপমহাদেশের ৫১টি তীর্থক্ষেত্রের দুটি ছিল সিলেটে। এই তীর্থক্ষেত্রগুলোর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হচ্ছে-ভগবান ব্রক্ষার পুত্র ছিলেন প্রজাপতি দক্ষ। প্রজাপতির দক্ষের কন্যা সতীর বিয়ে হয় প্রভু শিবের সঙ্গে। শিব জগৎ সংসারের খোজঁখবর তেমন রাখতেন না। সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতেন ধর্মকর্ম নিয়ে। ফলে স্ত্রী সতীর যত্ন নেওয়া সর্বদা সম্ভব হত না। প্রজাপতি দক্ষ মনে করলেন তাঁর কন্যা সতী স্বামীগৃহে অবহেলিত ও অপমানিত হচ্ছে। তাই তিনি অন্যান্য দেবতার কাছে শিবের কুৎসা রটাতে শুরু করলেন এবং শিবকে অপমানিত করার জন্যে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করলেন। ত্রিভুবনের সকল দেবদেবী নিমন্ত্রিত হলেন। কিন্তু শ্বশুরের যজ্ঞে শিবের কোন স্থান ছিল না। দেবর্ষি নারদ এই যজ্ঞের খবর সতী এবং শিবকে জানালেন। সতী নিমন্ত্রিতা না হলেও নন্দীকে সঙ্গী করে পিতার দেয়া যজ্ঞে উপস্থিত হলেন। জাঁকজমকহীভাবে সতীকে আসতে দেখে প্রজাপতি দক্ষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি যজ্ঞ মধ্যে প্রকাশ্যে শিব নিন্দা আরম্ভ করেন। স্বামী নিন্দা শুনে সতী মর্মাহত হন এবং আকস্মিকভাবে প্রাণত্যাগ করেন। নন্দী এই মৃত্যু সংবাদ শিবের কাছে পৌঁছায়। স্ত্রী মৃত্যু সংবাদ শুনে শিব সপ্তস্বর্গ ভেদ করে প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ড থেকে বের হয়ে আসেন। সব দেব-দানবরা তাঁর সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। শিব অনায়াসেই প্রজাপতি দক্ষকে হত্যা করেন। পত্নী শোকে উম্মাদ শিব তখন সতীর মৃতদেহ স্কন্ধে (কাঁধে) ধারণ করে উম্মাদনৃত্য শুরু করেন। তাতে স্বর্গ-মর্ত-পাতাল প্রকল্পিত হয়ে ওঠে। বড় ধরনের কোন ক্ষতির আশংকায় বিশ্বের ত্রাণকর্তা বিষ্ণু সুদর্শনচক্র দিয়ে শিব স্কন্ধে রক্ষিত সতীর মৃতদেহ খন্ড-বিখন্ড করেন। সতীর শরীর ৫১টি অংশে বিভক্ত হয় এবং সেগুলো উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। সিলেটশহর থেকে আট কিলোমিটারের মধ্যে খাদিম নগরের ‘কালাগোল’ নামক স্থানে, ‘গ্রীবাপীঠ’ এখানে দেবী সতীর গ্রীবা বা ঘাড়ের এক অংশ পতিত হয় এবং জৈন্তার ‘ফালজুর’ নামক স্থানে ‘বামজঙ্ঘা’ তীর্থক্ষেত্র অবস্থিত। এই স্থানে দেবীর বাম উরুর অংশ পতিত হয়েছিল।এ সব তীর্থক্ষেত্র দর্শনে পাপ মোচন ও পূন্য অর্জন হয় বলে প্রাগৈতিহাসিক কাল খেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এই বিশ্বাস প্রচলিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে মহাভারত রচয়িতা ব্যাসদেবের ভাষায়, ‘আমার পরমা রাধায় প্রপিতামহী সতী অরুন্ধতী শ্রীভূমির কন্যা ছিলেন’।
সিলেট বৌদ্ধ ধর্মেরও লীলাভূমি ছিল। বৌদ্ধগ্রন্থ মতে, সিলেট শহরেই ছিল জাগ্রত বৌদ্ধতীর্থ। সাধনমালা গ্রন্থে ওড়িয়ান পুর্ণগিরী ও কামাখ্যার সাথে সিলেট সিদ্ধপীঠের উল্লেখ আছে। ডাকার্ণব গ্রন্থে উল্লেখিত ৬৪টি তীর্থক্ষেত্রের একটি ‘হরিকোল’ বা ‘হরিকেল’। ‘হরিকেল’ সিলেটেরই একটি নাম বলে গবেষকদের অভিমত।
চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ চর্যাপদ রচনা করেন। চর্যার ভাষা, শব্দ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে গবেষক অধ্যাপক আসাদ্দর আলী দেখিয়েছেন যে, চর্যার একাধিক পদকর্তা সিলেটের লোক ছিলেন।
প্রাচীনকালে রাজ-রাজারা তামার পাত বা প্লেটে রাজকীয় ঘোষণা, অনুশাসন ইত্যাদি খোদাই করে রাখতেন। এ ধরনের তাম্রফলক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ন উপকরণ। ১৯১২ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ সময়ে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার নিধনপুরে ছয় খানা তাম্রফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো সপ্তম শতাব্দীতে উৎকীর্ন। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজার জেলার ভাটেরায় (রেলপথে মাইজগাঁও কুলাউড়ার মাঝামাঝি) পাওয়া গেছে দুইখানা তাম্রফলক। এগুলো একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর বলে পন্ডিতরা মনে করেন। এসব তাম্রফলক থেকে জানা যায়, সপ্তম শতাব্দীতে সিলেট কামরুপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কামরূপের মহারাজা ভাস্কর বর্মা ছিলেন সিলেটের শাসনকর্তা। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজার রাজনগর থানার পশ্চিমভাগ গ্রামে প্রাপ্ত দশম শতাব্দীতে উৎকৃর্ণ বিক্রমপুরের মহারাজা শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনের লিপি থেকে শ্রীহট্ট মন্ডলের সীমানা জানা যায়। চীন দেশীয় পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কর বর্মার আক্রমণে কামরূপ ভ্রমণ করেন। তিনি সিলেটকে ‘শিলাচটলো’ বলে উল্লেখ করেছেন। শিলাচটলো ছিল সমুদ্রতীরে। এর চারিদিকে ছিল পাহাড় ও বনভূমি। মনিপুর কাছাড়, জৈন্তা, সিলেট, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে প্রায় দুই হাজার বর্গমাইল এলাকায় ঐ সময় কামরূপ রাজ্য বিস্তৃত ছিল। তখন সিলেট অধিবাসীরা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী।
কামরূপের রাজা কামাসিন্দুর মৃত্যুর পর কামরূপ আক্রান্ত হয়। রানী উর্মি পালিয়ে এসে জৈন্তায় নারী রাজ্যের অংশে বিশেষ রাজ্য স্থাপন করেন। হাটকের (তিব্বত) ‘কৃষক’ নামীয় যুবরাজ ভ্রমণে এসে রানী উর্মির রূপসী কন্যা ‘উর্বরাকে’ বিয়ে করেন। কৃষক পিতৃরাজ্যে ফিরে যান। উর্বরার গর্ভজাত সন্তানের নাম রাখা হয় ‘হাটক’। যথাসময়ে হাটক সিংহাসনে বসেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র ‘গুহক’ সিংহাসনে আসীন হন। গুহকের তিন পুত্র-‘লড্ডুক’,‘গুড়ক’ এবং ‘জয়ন্তক’। দুই কন্যা-“শিলা’ ও ‘চটলা’। রাজা গুহকের মৃত্যুর পর তিন ভাইয়ের মধ্যে বিভক্ত রাজ্যের নাম হয় লড্ডুকের ‘লাউড় রাজ্যে’, গুড়কের ‘গৌড় রাজ্য’ এবং জয়ন্তকের ‘জৈন্তা রাজ্যে’। এ বর্ণনা থেকে জানা যায় হযরত শাহজালাল(র:) আগমনের পূর্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা বর্তমান থাকলেও প্রধানত গৌড়, লাউড়, জৈন্তা এই তিনটি রাজ্যে সিলেট বিভক্ত ছিল।
রাজা গৌড় গোবিন্দ সিলেটের শেষ হিন্দু রাজা। গৌড় গৌবিন্দের বংশ পরিচয় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ রয়েছে। কেউ বলেন তিনি গারো ছিলেন। কেউ বলেন ত্রিপুরা রাজ্যের নির্বাসিতা কোন মহিলার সন্তান। তিনি খাসিয়ার রাজাকে পরাজিত করেন। পরে লাউড় ও জৈন্তার রাজা তার বশ্যতা স্বীকার করেন। গোবিন্দের রাজাত্বকাল চল্লিশ বছর। এই গৌড় গোবিন্দ এবং তার গৌড় রাজ্যের কুল দেবতা হট্টনাযের নামানুসারে গনেশরাম শিরোমনির হট্টনাযের পাঁচালীতে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। ত্রিপুরার রাজমালা ও ভাটেরার তাম্রফলকের সাথে পাঁচালীর অনেক বর্ণনার মিল রয়েছে, গৌড়ের শেষ রাজা গোবিন্দকে পরাজিত করে হযরত শাহজালাল (র:) সিলেট প্রবেশ করেন এবং এই এলাকার সামগ্রিক জীবনে নিয়ে আসেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
হযরত শাহজালাল (র:) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সঙ্গী আউলিয়াদের নিয়ে প্রায় বিনা যুদ্ধে সিলেট জয় করেন। জালিম রাজা গৌড় গোবিন্দ ছলচাতুরীর আশ্রয় নিলেও শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যান। কথিত আছে শাহজালাল (র:)-এর সঙ্গে অনীত আরবের একমুঠো মাটির সাথে সিলেটের মাটির সাদৃশ্য পেয়ে তিনি এখানেই অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেন এবং এখানেই ১৩৪০ (৭৪০ হিজরিতে) খ্রিস্টাব্দে ৬৯ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। হযরত শাহজালাল (র:) যখন সিলেট আসেন তখন বাংলার সুলতান ছিলেন শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহ (১৩০১-১৩২২)। সে সময়ে তরফ, ইটা, পঞ্চখন্ড, ও প্রতাপগড় ছিল ত্রিপুরা মহারাজার অধীনস্ত ছোট ছোট সামন্ত রাজাদের অধীনে। সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখনো পানির নিচে। জৈন্তা তখন হিন্দু রাজার শাসনাধীন। ঐ সব এলাকায় বাদে হযরত শাহজালাল (র:) এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়া বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। তাঁরা এ মাঠিকে আপন করে নিয়েছিলেন মনে প্রানে। মানবিক উদারতা ছিল তাদের আদর্শ ও বৈশিষ্ট্য। হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বী হওয়া দোষণীয় নয়, জালিম হওয়া দোষনীয় এই মনোভাবই ছিল দরবেশ ও মুসলিম শাসকদের। তাই হিন্দু মুসলিম সকলের নিকট সমান শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন হযরত শাহজালাল (র:)। তখন চিহ্নিত অঞ্চলের শাসনভার সেনাপতি সিকন্দর গাজীর উপর ন্যস্ত হয়। সিপাহ সালার নাসির উদ্দিন যান তরফ অঞ্চলে। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল। অনুমান করা যায় ঐ সময়ে সিলেট আসাম অঞ্চলে ইসলামের প্রসার ঘটে। হযরত শাহজালাল যখন সিলেট ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করলেন তখন তাঁর আধ্যাত্নিক শাক্তিতে সবাই মুগ্ধ হন এবং তাঁরই নামানুসারে ও জেলার নাম হয় জালালাবাদ।
সিলেট ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে মোগল শাসনাধীনে আসে। পাঠান বীর খাজা উসমান (১৫৭১-১৬১২) মোগল বাহিনীর মোকাবেলা করেন প্রবল বিক্রমে। মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পতনউষার গ্রামে ছিল তাঁর রাজধানী। এর ২০ কিলোমিটার পশ্চিমে দৌলম্ভাপুর নামক স্থানে সংঘঠিত যুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ দেন খাজা উসমান। উসমানের পতনের পর পাঠান শক্তির পরাজয় ঘটে এবং মোগল প্রভাব বিস্তার লাভ করে। ১৬১২ থেকে ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মোগলরা পর পর ৩০ জন ফৌজদার নিযুক্ত করে সিলেট শাসন করেন। ১৭৬৫ খৃস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতে বাংলার দেওয়ানি আসার পরও সিলেট ফৌজদারদের শাসনে ছিল। ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে সুপারভাইজার হিসাবে সিলেটে নিযুক্ত কোম্পিনীর প্রথম প্রতিনিধির নাম সামনার। তারপর কালেক্টর হিসাবে নিয়োগ পান উইলিয়াম মেকপীস থেকার। ১৭৭২-১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দ সময়ে তিনি বর্তমান ডিসির বাংলার স্থানে এবং এম.সি কলেজ টিলায় যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় বাসগৃহ নির্মাণ করেন। এরপর উল্লেখযোগ্য কালেক্টর হলেন রবার্ট লিন্ডসে। ১৭৭৮-১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ১১ বছর তিনি সিলেট ছিলেন। তাঁর সময়ে ১৭৮২ খ্রিস্টাব্দে সিলেটে সৈয়দ হ্দী ও সৈয়দ মেহদী ইংরেজ বিরোধীতায় শাহাদাত বরণ করেন। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে ১২ সেপ্টেম্বর সিলেটকে আসাম প্রদেশের সাথে যুক্ত করা হয়। এর আগে সিলেট ঢাকা ডিভিশনের অঙ্গ ছিল।
১৭৭৬ খৃস্টাব্দে সিলেটকে চারটি সাব ডিভিশনে বিভক্তির ঘোষনা দেয়া হয়। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সুনামগঞ্জ, ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে করিমগঞ্জ ও হবিগঞ্জ সাব ডিভিশন খোলা হয়। সদর সাব ডিভিশন আয়তনে বড় হওয়াতে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ শ্রীহট্ট বা মৌলভীবাজার সাব ডিভিশন চালু হয়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ প্রদেশ গঠিত হলে সিলেট আসাম থেকে বেরিয়ে এসে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের সাথে যুক্ত থাকে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে আসামভুক্তির সময় সিলেটবাসী এতে আপত্তি জানায়নি। কংগ্রেসী হিন্দু নেতৃবৃন্দ সিলেট বাংলার সাথে আন্দোলন করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত সিলেট ছিল প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ জেলা।
পাকিস্তানী আন্দোলনের সময় মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি গঠনের স্বপ্নে সিলেটের মুসলমান সমাজ সম্মুখ হয়ে ওঠে। ভারত বিভক্তির এই ক্রান্তিলয়ে আসাম প্রদেশভুক্ত সিলেট জমিয়ত উলামার একটি দল পাকিস্তানভুক্তির তীব্র বিরোধী ছিল। আসামে তখন কংগ্রেস সরকার। তাঁই সিলেটবাসীর মতামত যাচাইয়ের জন্য গণভোটের আয়োজন করা হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ ও ৭ জুলাই যথাক্রমে সোম ও মঙ্গলবার গণভোটের তারিখ নির্ধারিত হয়। পাকিস্তানের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য সিলেটের সর্বত্র তোড়জোড় শুরু হয়। অপরপক্ষেও চলে জোর তৎপরতা। জমজমাট প্রচারণা। পাকিস্তান পক্ষের প্রতীক ‘কুড়াল’ অপরপক্ষের প্রতীক ‘ঘর’। শান্তিপূর্ণভাবে দুই দিনে ভোট পর্ব শেষ হল। দেখা গেল পাকিস্তানের পক্ষে ২,৩৯,৬২৯ এবং বিপক্ষে পড়েছে ১,৮৪,০৪১ ভোট। সিলেট সদর সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার এবং করিমগঞ্জ ও কাছাড় জেলায় মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ মহকুমার বিস্তির্ণ জনপদের সে কী আনন্দ উল্লাস, কিন্তু এই আনন্দের মধ্যে সীমানা কমিশনার রেডক্লিফ রোয়েদাদ অনুযায়ী করিমগঞ্জ মহকুমার পাথারকান্দি, রাজবাড়ী বদরপুর ও করিমগঞ্জ থানার অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তান থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। গণভোট পূর্ববর্তী সিলেটের আয়তন ছিল ৮,৭৫৩ বর্গকিলোমিটার। সাড়ে তিন থানা ভারতভুক্ত হওয়াতে ৭,৬৯৯ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে সিলেট পাকিস্তানভুক্ত হয়। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারীতে সিলেটের লোকসংখ্যা ছিল ৩০,৫৯,৩৬৭ জন এবং ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের আদমশুমারী রিপোর্ট অনুযায়ী এর সংখ্যা ছিল ৩৪,৮৯,৫৮৯ জন। স্বাধীনতার পর ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ধারাবাহিকতায় সিলেট জেলাকে চারটি স্বতন্ত্র জেলায় রূপান্তরিত করা হয়। সিলেটবাসীর দীর্ঘ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে চারটি জেলা নিয়ে সিলেটকে বিভাগ হিসেবে ঘোষনা দেয়া হয়। ১৯৯৫ সালের ১ আগস্ট সিলেট বিভাগের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।